×

জাতীয়

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনন্য নির্মাণ কৌশল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২২, ০৮:৪২ এএম

  • বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধের গভীর পাইলিং
  • সর্বোচ্চ সক্ষমতার বিয়ারিংয়ের ব্যবহার
  • বিশ্বে প্রথম একই সঙ্গে কংক্রিট এবং স্টিলের ব্যবহার

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পুরো জাতি উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের নানান প্রান্তে শুরু হয়েছে আলোচনা। সবাই সেতু নির্মাণের নানান খুঁটিনাটি বিষয় জানার চেষ্টা করছে। উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।  বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে প্রতিটি কাজে বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণ সামগ্রীর সহায়তা নেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কৌশলে অসাধারণ সাফল্য এসেছে যা সারা বিশ্বের কাছে মাইলফলক হয়ে আছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা নিরলসভাবে এই কাজ করে গেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বিশ্বের খরস্রোতা নদীর তালিকায় ব্রাজিলের আমাজনের পর বাংলাদেশের পদ্মা দ্বিতীয় ‘আনপ্রেডিকটেবল’ নদী। এই নদীর ওপর সেতু নির্মাণ মোটেই সহজ ছিল না। এমন খরস্রোতা নদীর উপর বিশ্বে আর মাত্র একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুকে টেকসই করতে নির্মাণে বিশেষ প্রযুক্তির পাশাপাশি উচ্চমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সবচেয়ে ভালো রড, সিমেন্ট, স্টিল, পাথর খুঁজে এনে ব্যবহার করা হয়েছে পদ্মা সেতুতে। জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকেও পরামর্শক এসে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করেছেন।

যে কোনো সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে নদীশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে মোট ১৪ কিলোমিটার নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এরমধ্যে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে এবং ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে। নদীশাসনের জন্য চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়। শুধু নদী শাসনের কাজে বিশ্বের কোথাও এতবড় দরপত্র কখনো হয়নি। পদ্মা সেতুর জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে পাথর আমদানি করা হয়- যার প্রতিটির ওজন ১ টন।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের এমন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা নিয়ে পদ্মা সেতুর মতো চ্যালেঞ্জ কমই নিতে হয়েছে। পদ্মা নদীর তলদেশের মাটির গঠনের ভিন্নতার কারণে সেতুর ১৪টি পিলার নিয়ে ১ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ১৪টি পিলারের ডিজাইন বার বার পরিবর্তনের কারণে নির্মাণ কাজ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। জটিলতা অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেনডেল এর সহযোগিতাও নেয়া হয়। সেতুর ডিজাইনের সময় পদ্মা নদীর তলদেশের ১৪টি স্থানের মাটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেতুর পিলারের নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়। অর্থাৎ প্রায় ৪০ তলা ভবনের উচ্চতার সমান গভীরে পাইল নিয়ে যেতে হয়েছে। এসব পাইল ৩ মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বের কোথাও এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীর পাইলিংয়ের প্রয়োজন হয়নি। এক একটি পিলারের পাইলের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬টি থেকে ৮টি করতে হয়েছে। পিলারের ডিজাইন করার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে প্রায় ৪ হাজার টন ওজনের কোনো জাহাজ সেতুর পিলারে ধাক্কা লাগলেও সেই ধাক্কা সামলানোর সামর্থ্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তের ৬ নম্বর পিলার দিয়ে পদ্মা সেতুর কাজের উদ্বোধন করা হয়েছিল।

জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে ভূমিকম্প প্রতিরোধে শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক বিয়ারিং স্থাপন করা হয়েছে। এই ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা ১০ হাজার টন। অর্থাৎ রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও পদ্মা সেতু টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি।

যে কোনো সেতুর পিলার ও স্প্যানের মাঝখানে একটি শক্তিশালী বিয়ারিং থাকে। পদ্মা সেতুতে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও ইতিপূর্বে এ ধরনের বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতুতে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি।

পদ্মা সেতুর পাইলিং ও পিলারের অংশে সাধারণ কোনো সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা অতিমিহি ‘মাইক্রোফাইন’ সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। সেতুর সড়কপথে পানি নিরোধক রাসায়নিকের স্তর তৈরিতেও বিদেশি সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। চার মিলিমিটার পুরুত্বের এই স্তরকে প্রকৌশলীরা ‘ওয়াটারপ্রুফ মেমব্রেন’ নামে অভিহিত করছেন। ইংল্যান্ড ও ইতালি থেকে এই স্তর তৈরির জন্য রাসায়নিক আমদানি করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর পিচের পুরুত্ব হবে ১০০ মিলি মিটার। পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত লাইটপোস্ট ও লাইনগুলো চীন থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে। সাধারণ আলোক সুবিধার পাশাপাশি এই সেতুতে সাধারণ লাইটের পাশাপাশি আর্কিটেকচার লাইটিং করা হয়েছে।

দ্বিতল পদ্মা সেতুতে নিচতলা দিয়ে চলবে ট্রেন এবং দ্বিতীয় তলার ৪ লেনের সড়ক দিয়ে মোটরযান চলবে। এই সেতুর মূল কাঠামোর উচ্চতা সেতুর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম অর্থাৎ সমান থাকবে। এর কারণ হচ্ছে স্টিল ও কংক্রিটের মিশ্রণে তৈরি ‘ডবল ডেকের’ পদ্মা সেতুর নিচতলা দিয়ে রেলগাড়ি চলবে। সেতুর কাঠামো সমান না রাখলে রেল চলাচল করতে পারবে না। এছাড়া নৌযান চলাচলের বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়েছে। রেলব্রিজ থেকে পানির দূরত্ব থাকবে ১৮ মিটার। ফলে পানির স্তর বাড়লেও সেতুর নিচ দিয়ে পাঁচ তলা উচ্চতার নৌযান যে কোনো সময় অনায়াসেই চলাচল করতে পারবে।

পদ্ম সেতুতে রেললাইনের স্টিংগার লুক্সেমবার্গ থেকে তৈরি করে আনা হয়। চীনের উহান শহর থেকে স্প্যান ও ট্রাস তৈরি করে আনা হয়েছে। সেতুর পাইল ড্রাইভের জন্য বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিশালী হ্যামার ‘মেংক’ জার্মানি থেকে আনা হয়েছে। ৩টি হ্যামার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে যুক্ত ছিল। হ্যামারগুলো শুধু জার্মানির মিউনিখ শহরে তৈরি হয়। এত শক্তিশালী হ্যামার বিশ্বের আর কোনো দেশের কাছে নেই। এই ড্রাইভিং হ্যামার জার্মানি বিক্রি করে না। এ ধরনের হ্যামার কেউ কিনে এনে পরিচালনা করার সাহসও পায় না। পাইলগুলো ড্রাইভ করার জন্য ১৪ জার্মান নাগরিক প্রায় সাড়ে ৪ বছর সেতুর প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন। ২৯৮টি পাইল ড্রাইভ করা হয়। এই হ্যামারগুলোর সক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ১৯০০, ২৪০০ ও ৩৫০০ কিলোজুল।

পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে। ভাসমান এই ক্রেনটির নাম ‘তিয়ান-ই’। পিলারের ওপর স্প্যানগুলো বসাতে ক্রেনটি চীন থেকে আনা হয়। এজন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হয়েছে। সাড়ে তিন বছরে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বিশ্বে এটাই প্রথম কোনো সেতুর নির্মাণ কাজে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় রাখা হয়। ক্রেনটির দাম ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। স্প্যানগুলো উঠানোর পর ক্রেনটি আবার চীনে ফিরে গেছে।

উল্লেখ্য, ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা সেতু ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সংযোগ স্থাপন করেছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেতুটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের বুকে এক রোল মডেল। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি (এমবিইসি)’ মূল সেতুর নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পায়। এছাড়া চীনের অপর প্রতিষ্ঠান ‘সিনো হাইড্রো করপোরেশন’ নদীশাসনের কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রকৌশালীদের সঙ্গে ৪০০ চীনা কর্মী প্রকল্পের কাজে অংশ নেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App