×

অর্থনীতি

বৈদেশিক বাণিজ্যেও ঢেউ লাগবে, আসবে বিনিয়োগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২২, ০৮:০৩ এএম

বৈদেশিক বাণিজ্যেও ঢেউ লাগবে, আসবে বিনিয়োগ

পদ্মা সেতু। ছবি: ভোরের কাগজ

ছিল অনেক বাধা- অর্থ সংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতির অভিযোগ, দেশি-বিদেশি সমালোচনা, বিশ্বব্যাংকের বৈরী আচরণ। ছিল প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জও। এত জটিলতার বিপরীতেও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন পদ্মা সেতুর দ্বার খুলছে আগামী ২৫ জুন। সেতুর এক প্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা।

ঐতিহাসিক এ মুহূর্তটিকে ঘিরে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্দীপনার ঢেউ। অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারের আশা করছেন সবাই, যার ঢেউ লাগবে বিদেশি বিনিয়োগেও- এমনটই মনে করেন ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। সেতু ঘিরে পদ্মার দুপাড়ে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিনটি বন্দর একত্রে কাজে লাগানো যাবে। এতে দূর হবে বন্দর জটিলতা। পণ্য রপ্তানিতে সময় লাগবে কম। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়মকানুনের যে বাধাগুলো রয়েছে তা সংস্কার না হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা আর বাস্তবে দেখা দেবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দৃশ্যমান ফল দেখতে এই মুহূর্তে ভারতকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তারা।

বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিভিন্ন সামাজিক সূচকের ক্রম উন্নতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থে করার কারণে বাংলাদেশের সক্ষমতার স্বীকৃতি মিলেছে। এ সেতু দেশের ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এছাড়া দেশের সার্বিক জিডিপির পাশাপাশি অতিরিক্ত ১ দশমিক ২৩ শতাংশ জিডিপি বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নতি হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে ইতোমধ্যে দেশে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়তে শুরু করেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছিল। জুনে পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে, সেই খবরে কয়েক মাস ধরেই দেশে বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছিল। সে কারণেই শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি, পরিবহন খাতের বাস-ট্রাক তৈরির যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতের সব ধরনের যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম আমদানি বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর ‘দেশি বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে’ অর্থনীতির এ সূত্রকে সত্যি প্রমাণ করেই দেশে এখন বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেশে বিদেশি বিনিয়োগের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩৮৮ কোটি ২০ লাখ (৩ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে ২৮১ কোটি ১০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। এ সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপিত হবে। পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণ বাংলার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধু মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে।

পদ্মা সেতু বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে কীভাবে ভূমিকা রাখবে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের ছোট্ট একটি দেশ। এখানে কৃষিপণ্য বিশেষ করে প্রচুর সবজি উৎপাদন করা হয়। সবজিগুলো দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনার কারণে সময় বেশি লাগে, পণ্য পচে যায়। ফলে কৃষকও ঠিকভাবে দাম পায় না। এছাড়া এত দিন শুধু চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করা যেত। এখন মোংলা এবং পায়রা বন্দর সবই কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে লোকেশন, কমিউনিকেশন, ইনফ্রাস্ট্রাকচারের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে গড়ে উঠবে। পর্যটনে বড় প্রভাব পড়বে। কারণ কুয়াকাটা একটি অন্যতম পর্যটন স্থান। এত দিন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না, তাই মানুষ আগ্রহ দেখাত না। এখন গতিশীলতা বেড়ে যাবে। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান আমরা প্রত্যাশা করছি।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়মকানুনের যে বাধাগুলো রয়েছে তা যদি কোনো রকম সংস্কার না হয় তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা আর বাস্তবে দেখা দেবে না। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবে। আর উৎপাদন ও বিনিয়োগও বাড়বে। আগে যারা দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাননি, এখন তারা আগ্রহ দেখাবেন। এতে আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভারতকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দৃশ্যমান ফল দেখতে হলে এ মুহূর্তে ভারতকেই গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে হলে দুদিকের সংস্কার প্রয়োজন, তবে সংস্কার বাস্তবায়ন কিছুটা কঠিন। কারণ, আমার মনে হয় ভারতের দিকে সমস্যা বেশি। বর্ডার ক্রসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্যগুলোর যে নিয়মকানুন সেগুলোর সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। শুধু নদীসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করলে হবে না। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। জাহিদ হোসেন বলেন, ভারত ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কটা রাজনৈতিকভাবে একটু স্পর্শকাতর, এছাড়া পদ্মা সেতুর কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে বহিঃবাণিজ্য সম্প্রসারণে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। আবার ভুটান খুব ছোট একটি রাজ্য। নেপালে কিছু বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App