×

জাতীয়

বিপজ্জনক জেনেও সংরক্ষণে ত্রুটি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২২, ০৭:৩৮ এএম

বিপজ্জনক জেনেও সংরক্ষণে ত্রুটি

ছবি: ভোরের কাগজ

সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বি এম কন্টেইনার ডিপোতে কন্টেইনার ভর্তি যে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ জড়ো করেছিল প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ তা সংরক্ষণেও মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। এখানে কী পরিমাণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক জড়ো করা হয়েছে সে ব্যাপারে গতকাল সোমবার পর্যন্ত কোনো তথ্য দেননি তারা কাউকে। এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণের জন্য যেসব বিভাগের অনুমতি নিতে হয় তাও তারা দেখাতে পারেননি। গতকাল সোমবার রাসায়নিক ভর্তি আরো ৪টি কন্টেইনারের সন্ধান পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর কর্মরত টিম। কিন্তু এছাড়াও আরো কী পরিমাণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভর্তি কন্টেইনার রয়েছে তা নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিকপক্ষের কাউকেই গতকাল সোমবার পর্যন্ত কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি ঘটনাস্থলে। এমনকি মোবাইল ফোনেও তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে গতকাল বিকালে হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদে ঠাণ্ডাছড়ি এলাকায় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন বন্ধ করার দাবিতে ফ্যাক্টরির সামনে স্থানীয় অধিবাসীরা বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন। তাদের দাবির মুখে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন বন্ধ রাখবে বলে জানিয়েছে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গাজী আক্কাস ভোরের কাগজকে বলেন, যেহেতু এই হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মজুত থেকে বিস্ফোরণে এত মানুষের হতাহত হওয়ার মতো মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তাই স্থানীয় জনসাধারণ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন কখন আবার এখানে বিস্ফোরণ ঘটে। এটি একটি জনবসতিপূর্ণ এলাকা। এ রাসায়নিক পদার্থ নিরাপদে ও নিয়মনীতি না মেনে পরিবহন, সংরক্ষণ করলে যেহেতু বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে তাই আমরা ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখতে বলেছি। ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষও তা মেনে নিয়েছেন। গতকাল এই বিক্ষোভের সময় আওয়ামী লীগ ও পরিবহন মালিক নেতা মঞ্জুর আলম মঞ্জু, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাফর আলম চৌধুরীসহ স্থানীয় জনগণ অংশ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে এবং বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ একই। সঠিক তথ্য জানতে গতকাল সোমবার বিএম কন্টেইনার ডিপো লিমিটেড ও আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের পরিচালক মুজিবুর রহমানের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করলেও এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তারও কোনো উত্তর দেননি। একইভাবে বিএম কন্টেইনার ডিপোর মুখপাত্র মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী একবার ফোন রিসিভ করলেও ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, অরক্ষিত অবস্থায় রাখার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। ডিপোর শ্রমিকরা বলছেন, এই রাসায়নিক পদার্থ কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই ডিপোতে রাখা হয়। এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ বিশেষ ব্যবস্থায় নিরাপদে রাখার নিয়ম থাকলেও সেসব নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেনি বিএম ডিপোর মালিকপক্ষ। এমনকি গত শনিবার রাতে আগুন লাগার পর আগুন নেভাতে যখন ফায়ার সার্ভিসের

অগ্নিনির্বাপণকারীরা সেখানে পৌঁছায় তাদেরও কোনো ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেনি এই প্রতিষ্ঠানের কেউ। ফলে ফায়ার সার্ভিসের টিমকে তাদের নিজেদের মতো করেই আগুন নেভানোর কাজ করতে হয়েছে। আর সেই আগুন নেভাতে গিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভর্তি কন্টেইনার আগুনের তাপে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে অকাতরে প্রাণ গেলো ৯ ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ আরো অনেকের। এমনকি গত রবিবার চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান যখন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান তখনো সেখানে এই কন্টেইনার ডিপোর কেউই ছিলেন না। তিনি এমন গাফিলতি ও অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, এত বড় একটি দুর্ঘটনা কিন্তু ডিপোর দায়িত্বশীল কেউ নেই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বন্দর চেয়ারম্যানের ভাষ্য অনুযায়ী এই ডিপোর প্রবেশ মুখেই রাসায়নিক পদার্থ ভর্তি ২৬টি কন্টেইনার ছিল এবং সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। বন্দর চেয়ারম্যানের তথ্যানুযায়ী দেখা যায় যে, এমন বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ জেনেও কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াই অন্য পণ্যবাহী কন্টেইনারের সঙ্গে এসব দাহ্য পদার্থ রাখা হয়েছিল।

অর্থাৎ ইয়ার্ডের ভেতরে কোনো আলাদা শেডে নয়, ডিপোর কন্টেইনার ইয়ার্ডেই পড়ে ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১ ও ২ জুন হাটহাজারী ফতেয়াবাদের আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড থেকে ৮৫০ টন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড সীতাকুণ্ডের এই ডিপোতে আনা হয়। রপ্তানির জন্য এসব রাসায়নিক পদার্থ কয়েকটি কন্টেইনার ভর্তি করে ইয়ার্ডে রাখা হয়। একটি শিপিং কোম্পানির জাহাজের শিডিউল দিতে না পারায় রপ্তানি বিলম্ব হচ্ছিল। বিএম কন্টেইনার ডিপো অব ডকের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘শিপিংয়ের শিডিউল পেতে দেরি হওয়ায় মালিক পক্ষ এসব রাসায়নিক পদার্থ কারখানায় ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। তবে এসব রাসায়নিক পদার্থ ইয়ার্ডে পড়ে ছিল।’

এই ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ নেয়ার কারণ হিসেবে কন্টেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে দায়ী করেছে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স। রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ভর্তি কন্টেইনার লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মকর্তা। কিন্তু গত শনিবার রাত ৯টার দিকে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এত হতাহতের ঘটনার দুদিনেরও বেশি সময় পার হয়েছে, কিন্তু এই ডিপো কর্তৃপক্ষ বা আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের কেউই কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছেন না।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেছেন, এই কন্টেইনার ডিপোতে কেমিক্যাল রাখার কোনো ব্যবস্থাপনাই ছিল না। সাধারণত কোনো কন্টেইনারে কী আছে, তার একটা চার্ট থাকার কথা। কেমিক্যালগুলো অবশ্যই অন্যান্য পণ্যভর্তি কন্টেইনারের সঙ্গে না রেখে পৃথক ব্যবস্থায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু এর কোনো কিছুই ছিল না ডিপোতে। ফায়ার সার্ভিস আগ্রাবাদ শাখার ইন্সপেক্টর মাহবুব-ই-ইলাহী বলেন, কর্তৃপক্ষ জানেনা কী কেমিক্যাল আছে সেটা কীভাবে হয়? আমরা এর আগের দুর্ঘটনায়ও দেখেছি মালিক পক্ষ তথ্য গোপন করে। এ কারণেই আমাদের ৯ সঙ্গীকে জীবন দিতে হয়েছে।

গত শনিবার সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কন্টেইনারে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ ৪১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া আড়াই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একটি বিশেষজ্ঞ দল, নৌবাহিনী এবং ঢাকা থেকে ফায়ার সার্ভিসের রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ টিম এসে আগুন নেভানোসহ কন্টেইনার ইয়ার্ডটিকে বিপদমুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দেখা নেই শুধু কন্টেইনার ইয়ার্ড মালিকপক্ষের। যা আরো বেশি সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App