×

সারাদেশ

চমেক হাসপাতালের বাতাসে পোড়া গন্ধ, আর্তনাদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২২, ০৯:৪১ পিএম

একের পর এক মরদেহ আসছে অ্যাম্বুলেন্সে করে। নিহতদের স্বজনের আহাজারি, বাতাসে পোড়া চামড়ার গন্ধ। বিস্ফোরণে-আগুনে দগ্ধ ও আহতদের যন্ত্রণার আর্তনাদ। নিখোঁজের স্বজনদের দুশ্চিন্তা, ছুটোছুটি। শনিবার রাত থেকে রবিবার (৫ জুন) বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্র ছিল এমনই।

চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীদের ভিড় ও স্বজনদের আহাজারি নতুন নয়। কিন্তু এতো মৃতদেহের বহর, স্বজনদের আহাজারি পুরো পরিবেশ পাল্টে দিয়েছে। চমেক হাসপাতালের এমন পরিবেশ আগে দেখেনি কেউ। স্বজনদের চিৎকার ও কান্নায় এখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে, হাসপাতালে শোকের মাতম। সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর কন্টেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ৫০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বিস্ফোরণে ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে পড়ে মানুষের দেহ এবং আগুনে দগ্ধ আহতদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে থাকে হাসপাতালে।

হাসপাতালের ভেতরে দগ্ধরা আর্তনাদ করছেন। আহত-নিহতদের স্বজনদের কান্নার রোল হাসপাতালজুড়ে। তাদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ। হাসপাতাল এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নিহত-আহতদের স্বজনেরা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজতে স্বজনরা ভিড় করছে হাসপাতালে।

এদিকে বিএম ডিপোসহ ওই এলাকা থেকে নিখোঁজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, চালক-হেলপার ও নিরাপত্তা প্রহরীর সন্ধানে চমেক হাসপাতালে ভিড় করছেন স্বজনরা। রোববার (৫ জুন) সকাল থেকে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে খোঁজ করতে দেখা যায় স্বজনদের। আবার কেউ ছবি ও আইডি কার্ড দেখিয়ে প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করার চেষ্টায় আছেন।

আব্দুস সোবহান প্রকাশ আব্দুর রহমান (২৮) নামে একজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি শেখেরখীল এলাকার বাসিন্দা সোবাহান ২০১৪ সালে বিএম কনটেইনারে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেন। তার ১ বছরের একটি কন্যা রয়েছে। নিখোঁজ আব্দুস সোবহানের মামা মো. হেফাজ উদ্দিন জানান, আমার ভাগিনা বিএম ডিপো কনটেইনার আগুন যখন লেগেছে তখন তার মা এবং স্ত্রীকে ভিডিও ফোনে আগুন জ্বলার দৃশ্য দেখান। এর কিছুক্ষণ পর তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক তার মৃত্যুর গুজব শোনা যাচ্ছে। তবে আমরা এখনও পর্যন্ত তার কোন সংবাদ পাচ্ছি না।

বিএম ডিপোতে কাজ করতেন ভোলার ফারুক। তার মেয়ে ফাতেমা বেগম সকাল থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরছিলেন। ওয়ান স্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারের সামনে তিনি বলেন, বাবা ইপিজেড থেকে আসা-যাওয়া করে বিএম ডিপোতে কাজ করতেন। শনিবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে কাজে গেছেন। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সীতাকুণ্ডের নিখোঁজ মনির হোসেনের ভাই আব্দুল হান্নান বলেন, মনির বিএম ডিপোতে কাজ করতেন। রাতে পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। এরপর আর খবর নেই।

বাঁশখালীর পুইছড়ি এলাকার রিদওয়ান ও রবিউলকে খুঁজতে এসেছেন প্রতিবেশী আমির আলম। তিনি বলেন, সীতাকুন্ডে আগুনের সংবাদ পেয়ে শনিবার রাতে রবিউল ও রিদওয়ান ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। এর পর থেকে তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইলও বন্ধ রয়েছে।

বিএম ডিপোতে কর্মরত ১৮ বছর বয়সী শ্রমিক শহীদুলকে খুঁজে পাচ্ছে না তার পরিবার। শনিবার রাতে অগ্নিকান্ডের সময় শহীদুল ডিপোতে কর্মরত ছিল বলে জানায় তার পরিবার। গতকাল রোববার সকাল থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রতিটি ইউনিটে শহীদুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার মামা শাহজাহান। তিনি বলেন, গত রাতে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সময় কাজ করছিল আমার ভাগিনা শহিদুল। বিস্ফোরণের পর দ্রুত সেখানে গিয়ে খোঁজ করলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, সারারাত ডিপোতে তাকে খুঁজেছি। লাশঘরে গিয়েও খোঁজ করেছি, কিন্তু পাইনি। জানি না, আমার ভাগিনা আদৌ বেঁচে আছে নাকি পুড়ে ছাই হয়েছে।

বিএম কনটেইনার ডিপোর এস্কেলেটর অপারেটর তৌফায়েল আহমদকে খুঁজছিলেন তার স্বজন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের পাঁচ মিনিট আগে ফেসবুক লাইভে ছিলেন তৌফায়েল। লাইভ শেষ হওয়ার আগেই বিকট শব্দ হয়। তার লাইভে অন্ধকার নেমে আসে। এর পর থেকে তৌফায়েলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তৌফায়েলের বাড়ি বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের নাপোড়া গ্রামে। দুই বছর আগে তিনি ওই কনটেইনার ডিপোতে কাজ নেন।

বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ক্রেন চালক মনির হোসেন (২৮)। শনিবার (৪ জুন) সন্ধ্যায় রাত্রীকালীন ডিউটিতে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু রাত ১১টার দিকে বিএম ডিপোতে ঘটে যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনার ১৪ ঘন্টা পার হলেও এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি মনির হোসেনকে। সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের উত্তর সলিমপুর ফকিরপাড়া গ্রামের মো. হান্নানের ছেলে নিখোঁজ মনির হোসেনের স্বজন মো. কুরবান আলী বলেন, গতকাল রাত থেকেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা চমেকে গিয়েও তাকে পাইনি। ডিপোতেও অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারছে না। আমরা চিন্তায় আছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App