×

জাতীয়

অর্থনীতিতে ফুটবে পদ্মফুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২২, ০৮:২৮ এএম

পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত। যে নদীর একদিন ছিল না কূল-কিনারা, সেই প্রমত্তা পদ্মার মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত এখন এক সুতোয় গাঁথা। শীতের কুয়াশা, আর বর্ষার উত্তাল তরঙ্গ- বারো মাসের সংকট কাটিয়ে পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে ২৫ জুন থেকে ছুটবে গাড়ি, চলবে ট্রেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ শুধু টোল সংগ্রহের জন্য নয়; অর্থনীতিতেও পদ্মফুল ফোটাবে এই স্বপ্নের সেতু- রাখবে বহুমাত্রিক-বহুমুখী অবদান। এ সেতু চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে যে ইতিবাচক গতি তৈরি হবে, প্রথম বছরে তার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে প্রাপ্তির পরিমাণ হবে ৩৩ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে বেশি। এর মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হবে, সেই কর্মকাণ্ড অর্থনীতিতে এক ধরনের কম্পন সৃষ্টি করবে। তবে জিডিপিতে অবদান আরো বাড়বে বলে মনে করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি জানান, পদ্মা সেতুর প্রভাবে ওপারের জনপদ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। ফিজিবিলিটি স্টাডি অনুসারে এ সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখবে বলে প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল। এখন তা দুই শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনা মহামারির মধ্যেও সরকারের মেগা প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি বেড়েছে। বর্তমান সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত ১০ প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ। এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। আগামী ২৫ জুন মহাসমারোহে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; যার মাধ্যমে সফল হতে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের পর আমরা মনে করি, আমাদের জিডিপিতে অন্তত আরো এক থেকে দুইভাগ সংযুক্ত হবে অর্থাৎ আমরা উন্নয়নের আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব। তিনি আরো বলেন, সেতুর নিরাপত্তা একান্তভাবে অপরিহার্য। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে- কখনো যদি বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয় আমরা যেন তা যথাযথভাবে প্রতিরোধ করতে পারি, সেই ভাবেই আমাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে আরো উন্নত, প্রশিক্ষিত ও সমৃদ্ধশালী করার পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রকল্পের প্রথম ভাগে জাজিরায় স্থাপনা নির্মাণের পর, এখন পুরোদমে চলছে মাওয়া প্রান্তে দ্বিতীয় ফেইজের নির্মাণকাজ।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের অর্থনীতির জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বার খুলে যাবে। পায়রা ও মংলাবন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে যাবে। এতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। যার অবদানও জিডিপিতে যুক্ত হবে। গত কয়েক বছর ধরেই উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে সড়ক-মহাসড়কে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জিডিপিতে অবদান রাখার পাশাপাশি পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যোগাযোগ, পরিবহন, বিপণন দ্রুততর হবে। এ কড়িডোরের বিভিন্ন জায়গায় প্রস্তাবিত ১৭টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন, বিনোদন কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এগুলো জিডিপিতে এক ধরনের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। দ্বিতীয়ত, এ সেতুর মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে, উপআঞ্চলিক এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য হাব তৈরি হবে। এর মাধ্যমে মোংলা এবং পায়রা বন্দরে সংযোগ স্থাপনের ফলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি সহজ হবে। এতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। যার অবদানও জিডিপিতে যুক্ত হবে। শুধু টোল সংগ্রহ নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বহুমাত্রিক এবং বহুমুখী অবদান রয়েছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতি গবেষক। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সুবিধা পেতে এখন আমাদের যথাযথ কৌশল নিতে হবে। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কর্মসংস্থানের চাহিদা সৃষ্টি হবে। সেই চাহিদা মেটাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে সরকারের জোর দেয়া উচিত। এখন জেলাগুলোতে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সেবা দেয়ার বিষয়টি সরকারকে চিন্তা করতে হবে।

তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানি অর্থ সহায়ক সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের বীজ বপন করা হয়। ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল পদ্মার পাড়ে, সেই স্বপ্ন এখন তীরে ভেড়ার অপেক্ষায়। আগামী ২৫ জুন সেতুটি চালুর মাধ্যমে দূরত্ব কমে যাবে দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের। নতুন বার্তা পৌঁছে যাবে দেশ এবং দেশের বাইরে।

সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশে সার্বিক জিডিপির সঙ্গে পদ্মা বহুমুখী সেতু ১ দশমিক ২৩ শতাংশ জিডিপিতে অবদান রাখবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরো বাড়বে।

বিবিএসের হিসাব বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। চলতি মূল্যে এর আকার ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বা ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতুর প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন এক শতাংশ ধরা হলেও আর্থিক মূল্য বাড়বে ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ছোট-বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু সংলগ্ন জাজিরার নাওডোবা এলাকায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে তোলা হচ্ছে। ঢাকার বাইরে পদ্মা সেতুর আশপাশের এলাকায় গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

পদ্মা সেতু ঘিরেই সোনালি ভবিষ্যৎ দেখছেন দেশের ২১ জেলার মানুষ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা হচ্ছে- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।

পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙা উপজেলা থেকে তিন দিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে। রপ্তানি পণ্যের লিডটাইম কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে।

ঢাকার বাইরে পদ্মা সেতুর আশপাশের এলাকায় গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ উঠে আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে।

পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে ২৯ শতাংশ বাড়বে নির্মাণকাজ, সাড়ে ৯ শতাংশ কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি, ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজ। এর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে। ফলে পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলে এর প্রভাব পড়বে সারাদেশে। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।

জিডিপির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সেতুর অবদানও বাড়বে। পদ্মা সেতু নির্মাণ করে লাভ কী হবে, তা নিয়ে ২০০৯ সালে আলাদা সমীক্ষা করে এডিবি ও জাইকা। এতে দেখা যায়, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) দাঁড়াবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ। যানবাহন চলাচল যত বাড়বে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ততই বাড়বে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App