×

জাতীয়

টার্গেট এবার রাজপথ দখল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২২, ০৮:২৯ এএম

টার্গেট এবার রাজপথ দখল

গত ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে ধাওয়া করে ছাত্রলীগ। ফাইল ছবি

 পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি

করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন রাজনীতি ‘ভার্চুয়ালে’ সীমাবদ্ধ ছিল। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা ঘরে বসেই ভিডিও বার্তা দিয়ে একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। এখন করোনার প্রকোপ কমেছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন- হাতে সময় আছে বছর দেড়েক। জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক আসছে ‘মাঠ গরম করা ইস্যু’। সংগত কারণেই জমে উঠেছে মাঠের লড়াই। দীর্ঘদিন পর রাজনীতি ফের রাজপথে। বিএনপি ও সমমনারা ‘সরকার হটানো’র কড়া কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে। নেতাদের বক্তৃতায় অসহিষ্ণুুতার আঁচ। হুংকার দিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরাও।

পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে দুই পক্ষই। দুই পক্ষই চায় রাজপথ দখলে রাখতে। অন্য দলগুলোও নিদেনপক্ষে নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিতে তৎপর। আর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে সচেতন মহল। মাঠের রাজনীতির দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে নজর রাখছেন সাধারণ মানুষও। টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ চাইছে নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে। আর বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে নিজেরা মসনদে বসতে। এজন্য বৃহত্তর জোট গঠন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে চায় দলটি। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোর নতুন নতুন কমিটি করছে তারা। সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন দলটির নেতারা। আর আওয়ামী লীগও ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজেদের করা উন্নয়নের কথা ব্যাপক হারে প্রচারের পাশাপাশি বিএনপিকে মোকাবিলায় মাঠে সক্রিয়। দলটির নেতাকর্মীদের সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকমান্ড। দুই দলই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।

বিএনপি দীর্ঘদিন রাজপথে খুব একটা নামতে না পারলেও গত মাসের মাঝামাঝি থেকে বেশ সোচ্চার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মসূচি দিচ্ছে। সরকারবিরোধী গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছেন দলটির নেতারা। পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। উভয় দলের নেতারা দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়েও কটাক্ষ করছেন। যার প্রভাব পড়েছে দল দুটির ছাত্র সংগঠনের মধ্যেও। দুই দলের নেতাদের বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যে রাজনীতির মাঠ এখন উত্তপ্ত। উত্তাল হচ্ছে ছাত্র রাজনীতিও। এত দিন ক্যাম্পাসগুলোয় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের আধিপত্য থাকলেও এখন বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল ঢাবি ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য চায়। সংগঠনটির নেতারা ‘গরম’ বক্তব্য দিচ্ছেন। কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে সরকারেরও। ছাত্রলীগও তাদের পাল্টা জবাব দিচ্ছে। ছাত্রদলকে প্রতিহতের ঘোষণা দিচ্ছে। ফলে ছাত্র সংগঠন দুটির পাল্টা বক্তব্যেও উত্তপ্ত মাঠ। ক্যাম্পাসে আধিপত্য নিয়ে ছাত্র সংগঠন দুটির মধ্যে সংর্ঘষও বাধছে। উভয় সংগঠনের দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। একে অন্যের নেতাকর্মীদের মধ্যে মামলা, পাল্টা মামলাও হয়েছে।

এদিকে ঘরের রাজনীতি মাঠে গড়াচ্ছে পুরোদমে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মাঠ চাঙ্গা করার পরিকল্পনা নিয়েছে দুই রাজনৈতিক দলই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সারাদেশে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন সম্মেলন করছে। মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ক্ষমতাসীন দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোরও সম্মেলন চলছে সমানতালে। একইভাবে সংগঠন গোছাতে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলো। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। নতুন কমিটি করা হয়েছে ছাত্রদল ও যুবদলেরও। বিভিন্ন জেলায় আহ্বায়ক কমিটিও করছে সংগঠনটি। উভয় দলের টার্গেট নিজ নিজ সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর। বিএনপির টার্গেট আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে মাঠে নামানো। তারা বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চায়। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।

এই দাবিতে আগামী দিনগুলোয় সোচ্চার থাকতে চায় দলটি। এজন্য প্রায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে সরকারবিরোধী গরম গরম বক্তব্য দিচ্ছেন নেতারা। নিজেদের সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে ছোট ছোট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আগামী দিনে সরকারবিরোধী বড় আন্দোলনের টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে ছাত্রদলকেও ঢাবিসহ প্রতিটি ক্যাম্পাসে শক্ত অবস্থান নিতে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে দলটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।

সেই নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২২ মে ঢাবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রদল। ওইদিন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছেন। যার ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। তারা ছাত্রদলকে ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। এরপর ছাত্রদল ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে তাদেরকে ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে ছাত্রলীগ। ছাত্রদলও যে কোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার ঘোষণা দেয়।

এদিকে ঢাবি ক্যাম্পাসসহ বিএনপির বিভিন্ন সমাবেশে সরকারবিরোধী বক্তব্যসহ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে রাজপথে বিএনপিকে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত ৩১ মে দলের এক সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ‘৭৫-এর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’- ফখরুলরা এসব স্লোগান ছাত্রদলকে শিখিয়ে দিয়েছেন। নেত্রীকে অপমান করা হচ্ছে। এই অপমান কি আমরা সইতে পারি? এসব কটূক্তির প্রতিবাদ ছাত্রলীগ করেছে। কাদের বলেন, ফখরুল সাহেব বলেন ‘ছাত্রদল দিয়ে বিএনপি আন্দোলন শুরু করবে’। আমরাও দেখব কত ধানে, কত চাল। সব কিছুর একটা শেষ আছে। বাড়াবাড়ি ভালো নয়। আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুন নিয়ে খেললে পরিণতি হবে ভয়াবহ। শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেবেন আমাদের সামনে। আওয়ামী লীগ কি মরে গেছে? আমরা কি রাজপথ কাউকে ইজারা দিয়েছি? আওয়ামী লীগ রাজপথ থেকে এসেছে, রাজপথেই আছে।

এ জন্য বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় নিজ দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। যে কোনো মূল্যে রাজপথ নিজেদের দখলে রাখতে নেতাকর্মীদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার নির্দেশ দেন তিনি। আজ সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করবে দলটি।

আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বক্তব্যে বলেন, যারা জোর করে ক্ষমতা দখল করে থাকে তারা কী ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। এটা আদায় করতে হবে, সেটা জনগণের শক্তিতেই আদায় করতে হবে। আমাদের তো কোনো শক্তি নেই, শক্তি একটাই- সেটা হচ্ছে জনগণ। আমরা সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে যে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করেছি, সেই ঐক্য প্রক্রিয়াকে সফল করি। পরিষ্কার বলতে চাই, এটা দেশের সব রাজনৈতিক দলের, বাম-ডান হোক, যেটাই হোক আমরা তাদেরকে এক কাতারে নিয়ে আসব। এই ভয়াবহ যে সরকার আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে, তার কবল থেকে মুক্তি পেতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচন হবে না। অবশ্যই আওয়ামী লীগকে সরে যেতে হবে। নিরপেক্ষ একটা সরকারের হাতে দায়িত্ব দিতে হবে। সেই সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।

এসব বিষয়ে গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। আমরা ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিকে অবাধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ দেই। বিএনপি সেই সুযোগের অপব্যবহার করে। যখন তারা অপব্যবহার করে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তারা জনগণের জানমাল রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। আমাদের দলের কোনো নেতাকর্মীও যদি অন্যায় করে থাকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকই ব্যবস্থা নেয়।

তিনি আরও বলেন, গত আড়াই বছর রাজনীতি মাঠে ছিল না, এটা ঠিক। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানবিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল। আমাদের নেতাকর্মীরা কোভিডকালে মানুষের কাছে গেছে। খাবার পৌঁছে দিয়েছে। করোনায় মৃতদের লাশ দাফন করেছে। কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়েছে। জনগণের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমাদের দলের প্রায় ৬ থেকে ৭০০ নেতাকর্মী মারা গেছেন। সে সময় কিন্তু বিএনপি ঘরেই ছিল। তারা মানুষের পাশে যাননি। তাদেরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা সব সময় জনগণের পাশে ছিলাম। করোনা পরিস্থিতির যেহেতু উন্নতি হয়েছে, আমরা রাজনৈতিক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করে দিয়েছি। তৃণমূল থেকে সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠন গোছানোর কাজ করছি। অন্যদিকে বিএনপি তাদের সংগঠনকে গোছানোর কাজ করছে। আমি মনে করি সেটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু তারা যদি কোনো অশুভ চক্রান্তের উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নামে, তাহলে আমরাও তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App