×

মুক্তচিন্তা

বাজার গরম, রাজনীতিরও তাপ বাড়ছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২, ০২:২৭ এএম

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম কারণেও দাম বাড়ে, অকারণেও বাড়ে। যেমন এখন ধানের মৌসুম। মৌসুমে সাধারণত ধানের দাম কম থাকে। এবার তার ব্যতিক্রম। কারণ কী? কেউ বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। বাইরে থেকে আমদানি করা জিনিসের দাম না হয় ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে বাড়তে পারে, দুনিয়াজুড়ে বাড়লে আমরা আর কম দামে পাব কীভাবে? কিন্তু ধানের মৌসুমে ধানের দাম বাড়লে কি সেটা মেনে নেয়া যায়? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কারণ খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছেন। দেখা যাক, কী কারণ খুঁজে পাওয়া যায়! ভোরের কাগজে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, চালের বাজারসহ খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দুই মন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন দুই মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবও। চালের দাম বাড়ানোর জন্য যে বিশেষ মহলের কারসাজি আছে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরদারির অভাব বা অন্য দুর্বলতা আছে তা যে কোনো সাধারণ মানুষও মনে করেন। দাম বাড়ছে নিয়মিত কিন্তু মানুষের আয় বাড়ছে না। মানুষ বাজারে গিয়ে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছেন, প্রতিকারের উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ওদিকে রাজনীতিতেও হাওয়া গরমের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী সব পক্ষ মাঠে নামার সুযোগ খুঁজছে। ৭ মে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সুবিধার জন্য দলটির শান্তিপূর্ণ উপায়ে ছোট সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়ার কথা বলেছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল। এই খবরটি রাজনৈতিক মহলে কিছুটা স্বস্তিও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সে স্বস্তি স্থায়ী হলো না। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করে যে বক্তব্য দেন তাতে বিএনপি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। ছাত্রদলকে মাঠে নামিয়ে পরীক্ষা করছে, সরকার কী করে! প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে। ওখানে চড়া যাবে না, চড়লে ভেঙে পড়বে। তার সঙ্গে তার কিছু দোসরও। এখন তাদের কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দেয়া উচিত। আর যে একটা এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকেও আবার পদ্মা নদীতে নিয়ে দুটা চুবানি দিয়ে উঠাইয়া নেয়া উচিত। মরে যাতে না যায়। পদ্মা নদীতে দুটা চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেয়া উচিত। তাহলে যদি এদের শিক্ষা হয়।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে বিএনপি তাদের নেত্রীকে ‘হত্যার’ হুমকি খুঁজে পেয়েছে। বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবার প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এমন কিছু অশালীন মন্তব্য করেছেন যা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ আওয়ামী ধারার সংগঠনগুলোকে উত্তেজিত করেছে। এই ঘটনার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদলের ওপর চড়াও হয়েছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পথেই বাধা পেয়েছে ছাত্রদল। একদিন নয়, তিন ধরে একইভাবে ছাত্রলীগের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে ছাত্রদলকে। ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। উভয় পক্ষেই অনেকে আহত হয়েছে, তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি এটাই যা! ছাত্রলীগের সভাপতি বলেছেন, ক্যাম্পাসে ঢুকতে হলে ছাত্রদলকে ক্ষমা চাইতে হবে। আমাদের দেশে রাজনীতিতে ক্ষমা চাওয়ার রেওয়াজ নেই। ছাত্রদলও তা চাইবে না। তাহলে কি ছাত্রদল আর ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবে না? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বিএনপি ও তাদের দোসরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে নোংরা ভাষায় সেøাগান দিচ্ছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় সেøাগান ও গালিগালাজের পরিণতি হবে ভয়াবহ। সরকারি দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তির এই বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, সরকারের নীতি-কৌশলের সমালোচনা সহ্য করলেও সরকারপ্রধানের ব্যক্তিগত সমালোচনা বা তার প্রতি ব্যক্তিগত কটাক্ষ করা আওয়ামী লীগ বরদাশত করবে না। কিন্তু বিরোধী দল কী বলবে বা বলবে না, তার যদি কোনো সীমানা টেনে দেয় সরকার পক্ষ তাহলে সেটা মেনে চলাও কি বিরোধী দলের পক্ষে সম্ভব? সমঝোতার মনোভাব দুই পক্ষেরই না থাকলে কোনোভাবে ফয়সালায় উপনীত হওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কখনো একমত হওয়ার কথা ভাবে না, শুধু বিরোধের জায়গাগুলো খুঁচিয়ে বের করে। সরকারের একতরফা সমালোচকদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভালো চোখে দেখেন না। বিরোধী বা সমালোচকরা যেমন সরকারের কোনো ভালো কিছু খুঁজে পায় না, তেমনি প্রধানমন্ত্রীও সমালোচকদের বিরুদ্ধে যখন মুখ খোলেন তখন তিনিও সহৃদয়তার জায়গা রাখেন না। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যেসব সমালোচক সরকারের কোনো উন্নয়ন দেখেন না তাদের এক হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এখন সবাই কথা বলতে পারেন, টকশো করতে পারেন। অবশ্য আমি জানি যে অনেক কথা বলার পরে বলবে, আমাদের কথা বলতে দেয়া হয় না। কিন্তু যখন টক শোতে কথা বলেন, কেউ তো আপনাদের মুখ চেপে ধরেনি বা গলা চেপেও ধরেনি। সবাই যার যার ইচ্ছেমতো বলতে পারেন।’ ঢাকায় বসে সরকারের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সবাইকে আমি বলব, আগে বাংলাদেশটা ঘুরে আসেন। গ্রাম পর্যায়ে যান। সেখানে মানুষ কী অবস্থায় আছে একটু দেখে এসে তারপর কথা বললে আপনারা হয়তো জানতে পারবেন।’ কিন্তু যারা সমালোচক তারা বাংলাদেশ ঘুরে এসেও খারাপই বলবেন। কারণ সব জায়গায় তো আর রাস্তাঘাটের এক রকম উন্নয়ন হয়নি। দেশে আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্যের মতো উন্নয়নবৈষম্যও আছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অনেকেই হয়তো এখন সমালোচনা করে বলেন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন করা হলো? এত টাকা খরচ হয়েছে। খরচের দিকটা সবাই শুধু দেখে। কিন্তু এই খরচের মধ্য দিয়ে কী লাভবান হবে এবং আমাদের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখবে। আমাদের উন্নয়ন গতিশীল হবে। মানুষের জীবন পরিবর্তন হবে। সেটা বোধ হয় তারা বিবেচনা করে না। এটা খুব দুঃখজনক।’ আসলে সবাই সবকিছু একভাবে দেখে না, সবার দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়। কেউ অল্পেই তুষ্ট হয়, কারো আবার অনেক পেয়েও মন ভরে না। তবে সরকারের উচিত বৈরিতা না বাড়িয়ে একটি এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে উত্তেজনা কমে, পরিবেশ সহনশীল থাকে। চরম কোনো পথ কাম্য নয়। তবে আমাদের দেশে এখন এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে যার আশু পরিবর্তন হবে বলে অনেকেই মনে করেন না। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হঠাৎ যদি মারমুখী হয়ে ওঠে, রাজনীতির বাজার তপ্ত হয়ে ওঠে তাহলেও আজকাল মানুষের মনে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া হবে বা হয় বলে মনে হয় না। রাজনীতিকরা যে এখন মানুষের চেয়ে নিজেদের কথা বেশি ভাবেন, সেটা মানুষের বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু বাজার মানে যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মানে শুধু চাল-ডাল, তেল-সবজি, মাছ-মাংসসহ নানাবিধ পণ্য বিকোয় সেখানে গরম হাওয়া বইলে মানুষের মধ্যে বড় প্রতিক্রিয়া হয়। বাজারে গরম হাওয়া ক্রমাগত গরম থেকে গরম হচ্ছে, মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে। আগে একটার দাম বাড়লে বিকল্প একটা দিয়ে মানুষ চালিয়ে নিতে চেষ্টা করত। যেমন চালের দাম বাড়লে ভাতের বদলে রুটি খেয়ে থাকত। এখন তো চাল, আটা, ময়দা সব কিছুরই দাম বাড়ছে। তরকারি রান্নায় তেলের ব্যবহার না হয় বন্ধ করা গেল, কিন্তু ভাত, রুটি না খেয়ে কি বেঁচে থাকা যাবে? টুথপেস্টের দাম ৭০-৭৫ টাকা হলে কেউ না হয় দাঁত মাজার জন্য গাছের ডাল বা অন্য কিছু খুঁজে নিল কিন্তু ৫০ টাকার পাউরুটি ৬৫ টাকা হয়ে গেলে কী দিয়ে পেট ভরাবে? কেউ হয়তো বলবেন, দাম কোন দেশে বাড়ছে না? সব দেশে বাড়ছে, বাংলাদেশেও বাড়ছে। তবে বাংলাদেশে কি মানুষ অনাহারে আছে? না, বিপুল সংখ্যক মানুষ হয়তো অনাহারে নেই কিন্তু সবাই চাহিদামতো খাবার খেতে পারছে বলে মনে হয় না। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মধ্যবয়সি এক ভদ্রলোক রাজধানীতেই মাঝারি মাপের একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী, তিন সন্তান আর মাকে নিয়ে বসবাস করেন। মরণব্যাধি করোনায় তার পরিবারে ঘা পড়েনি, কিন্তু ছুরি পড়েছে তার উপার্জনে। বেতন কমে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। হাতে বাজারের থলে নিয়ে মলিন মুখে ঘুরছিলেন রাজধানীর কারওয়ানবাজারে। মহল্লার চেয়ে একটু কম দামে জিনিস কিনতে তিনি নিয়মিতই এখানে আসেন। কথায় কথায় তিনি একজন গণমাধ্যম কর্মীকে বললেন, ‘সংসারের খরচ কাটছাঁট করে কোনোমতে দুবেলা খেয়ে-পরে আছি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, ভবিষ্যতে হয়তো তা-ও সম্ভব হবে না। আগে বাসায় দুধ-চা খাওয়া হতো। গুঁড়ো দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেই শখ কাটা পড়েছে। আগে যে পাউরুটি কিনতাম ৫০ টাকায়, এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫ টাকায়। টুথপেস্ট, টিস্যু, টয়লেট ক্লিনার, কাপড় কাচা সাবান- কোনটির নাম বলব? সবকিছুর দামই তো বেড়েছে।’ তাহলে সামলাচ্ছেন কীভাবে? জবাবে জানালেন দুই তরিকা। এক. পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছেন। দুই. ছাড় দিয়েছেন ব্র্যান্ডে। আগে হয়তো টুথপেস্ট বা টিস্যু কেনার সময় দোকানিকে কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের কথা বলতেন। এখন জানতে চান, দাম কম হবে কোনটার। এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে অনেকে ইসবগুলের ভুসি খান, বাদ যায়নি তার দামও। একজন ক্রেতার প্রতিক্রিয়া এমন : ‘তেল কিনলে চাল হয় না। চাল কিনলে তরকারি হয় না। তেল না হলে যে রকম তরকারি হয় না, সে রকম চাল না হলে খাওয়া হবে না। কোন দিকে যে যাব। বাজারে আসলে মাথা গরম হয়ে যায়।’ চারদিকে গরম হাওয়া বইতে শুরু হলে সব ঠিক থাকবে তো? বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App