×

জাতীয়

করোনায় সহিংসতার শিকার কিশোর-কিশোরীরা: গবেষণা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২, ০৯:০৪ পিএম

করোনায় সহিংসতার শিকার কিশোর-কিশোরীরা: গবেষণা
করোনায় সহিংসতার শিকার কিশোর-কিশোরীরা: গবেষণা

করোনা কালীন সংকটে দীর্ঘসময় স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনো-সামাজিক টানাপোড়ন, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশসহ বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। এ সময়ে শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবক ও কিশোর-কিশোরীদের নেয়া সিদ্ধান্তও তাদের ভবিষ্যতের পথকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। শুধু তাই নয়, তাদের জীবিকা এবং প্রজননস্বাস্থ্যও এর দ্বারা প্রভাবিত।

বুধবার (১ জুন) সকালে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ভালনারাবিলিটিজ অ্যান্ড ট্রানজিশান ইন দ্য কনটেক্সট অফ কোভিড-১৯’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং জিআইজেড’র রুল অল প্রোগ্রাম যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব উম্মে কুলসুম, ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার জাভেদ প্যাটেল, জিআইজেড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. অ্যাঙ্গেলিকা ফ্লেডারমান, জার্মান দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের উপপ্রধান ক্যারেন ব্লুম।

আলোচক ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক এম এম মাহমুদুল্লাহ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, ব্র্যাক শিক্ষা বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম এবং টেরে দেস হোমস এর ক্ল্যারিসা কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর ড. জিনিয়া আফরোজ। অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গবেষণার তথ্য বলছে, ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মহামারীর আগে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করতো। মহামারীর সময়ে কিশোর-কিশোরীদের এই হার ১৪ শতাংশে নেমে গেছে। যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার খুব একটা বেশি নয় তবুও, অন্তত ৩৫ শতাংশ ঝরে পড়া শিক্ষার্থী জানিয়েছে, কোভিড-১৯ এর কারণে তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, তারা পড়াশোনার খরচই আর চালাতে পারছে না।

মহামারীর আগে ও পরে বাল্যবিবাহের হারে সামান্য ব্যবধান হয়েছে বলেও গবেষণায় তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় অংশ নেয়া প্রায় ৫০ শতাংশ পিতামাতা জানিয়েছেন, মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কোভিড-১৯’র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিলো। মেয়েদের ও তাদের পরিবারের সম্মানকে সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে- কোভিডের সময়ে প্রতিনিয়ত এমন সামাজিক চাপের মুখে ছিল কিছু পরিবার। ফলে সেসব পরিবারের পিতামাতারা তাদের মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আয়োজকরা জানিয়েছে, মিশ্র পদ্ধতির এই গবেষণাটি করা হয়েছিলো ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। কোভিড-১৯’র সংকট কিশোর-কিশোরীদের জীবনে কিভাবে পরিবর্তন এনেছে তা বিশ্লেষণ করা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এদেশের নারী ও কিশোরীদের অবস্থা কেমন, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা বোঝাই ছিলো গবেষণার লক্ষ্য।

সমীক্ষা অনুসারে, বাল্যবিবাহ এবং স্কুল ছেড়ে দেয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়ে নিরাপত্তা এবং পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল বন্ধের প্রেক্ষাপটে ছেলেদের কাজে পাঠাতে অভিভাবকরা সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিবেচনা এবং কেবল দারিদ্র্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মোঃ গোলাম সারওয়ার বলেন, আমাদের নীতিনির্ধারনের ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং একইসাথে মানুষের সক্ষমতা ও সুস্ততাকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আরও স্থিতিস্থাপক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা প্রণয়নে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। সেই ব্যবস্তাই আমাদের লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক অবস্তা নির্বিশেষে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে একটি মৌল মানবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

উম্মে কুলসুম, বলেন, সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারের কৌশল এবং লৈঙ্গিক সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কাঠামোকে চিহ্নিত করেছে। কোভিড থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে লৈঙ্গিক সমতা এবং নারী ক্ষমতায়ন কাঠামোকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া দরকার। জাভেদ প্যাটেল বলেন, গবেষণার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার বোঝা যায় মহামারী কিভাবে কিশোর-কিশোরীদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে নেয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিশেষ করে কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে নেয়াটা হয়তো আরও অনিশ্চিত হবে।

তিনি বলেন, ইউকে সরকার সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে। নারী ও কিশোরীরা তাদের সফলতার পথটি যাতে স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে সে ব্যাপারে এই ধরনের গবেষণা আমাদের অনেক সহায়তা করবে।

ক্যারেন ব্লুম বলেন, এ বছর বাংলাদেশ-জার্মান অংশীদারিত্ব পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করলো। আজকের গবেষণার মত অন্যান্য গবেষণাগুলো উন্নয়ন অংশীদারিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়ন উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়ার জন্য সুযোগ তৈরি করা। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, কোভিডের কারণে কিশোর-কিশোরীদের সম্ভাবনা এবং সুযোগ কিভাবে সীমাবদ্ধ হয়েছেএ ড. অ্যাঙ্গেলিকা ফ্লেডারমান বলেন, কিশোর-কিশোরীদের উপর করা গবেষণা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ায় একটি অন্যতম ভুমিকা পালন করে, যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের ২১ শতাংশই তরুণ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর হাতে। শিশুদের জন্য সময়মত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে সেটা তাদের জীবন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে।

ড. ইমরান মতিন বলেন, কোভিডের সময়ে কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপারে খুব একটা গবেষণা এবং নীতিনির্ধারণী আলোচনা হয় নি। অর্থনৈতিক কারণ ও স্কুল বন্ধ থাকা- এই দুইয়ে মিলে তাদের জন্য আগে থেকেই চলমান ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং নতুন ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আমাদের গবেষণায় আমরা এটাই দেখার চেষ্টা করেছি এবং নীতি নির্ধারণে ও কর্মসূচী প্রণয়নে কিভাবে ব্যাপারটিকে তুলে ধরা যায়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা পর্যালোচনা, শিক্ষার মানের উপর গুরুত্বারোপ করা এবং সামাজিকীকরণের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের নীতিগত অগ্রাধিকার দেয়ার চেষ্টা করা।

গবেষণাটি জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএমজেড) এবং ইউকে ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এর সহায়তায় পরিচালিত হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App