×

অর্থনীতি

কালো টাকার অবাধ সুযোগ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২২, ০৮:১৮ এএম

বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে বিরল উদ্যোগ, কর দেয়ায় নিরুৎসাহিত হবে সৎ করদাতারা

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশে। আন্তর্জাতিকবাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তাই আগামী বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে কালো টাকার মালিকদের অবারিত সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বৈষম্য করা হচ্ছে সৎ করদাতাদের সঙ্গে। যেখানে অর্থ পাচার করলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের বিধান রয়েছে সেখানে পাচারের অর্থ ফেরাতে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দেয়া হচ্ছে।

এতে অর্থ পাচারকারিরা উৎসাহিত হবে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হবেন সৎ করদাতারা। আর এই উদ্যোগে তেমন সফলতা আসবে বলেও মনে করেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে এ ধরনের উদ্যোগ সাময়িকভাবে কিছুটা লাভবান হলেও দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে। কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা আরো বলছেন, যেখানে সৎ করদাতার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিয়ে থাকেন। সেখানে প্রায় অর্ধেক কর দিয়ে পাচারকারী কালো টাকার মালিকরা টাকা সাদা করে নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে তিনভাবে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দেয়া হচ্ছে। বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি থাকলে সেই সম্পত্তি দেশের আয়কর রিটার্নে দেখাতে চাইলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। আর অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। এছাড়া কেউ বিদেশ থেকে টাকা দেশের আনলে সেই টাকার ওপর ৭ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবে টাকা যোগ হওয়ার আগেই কর পরিশোধ করতে হবে। তবে এই টাকার উৎস নিয়ে আয়কর কর্মকর্তারা কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। অর্থাৎ কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই এসব অর্থ সাদা হয়ে যাবে। এর চেয়ে বড় বিষয় হলো- এই অর্থের বিষয়ে কোনো মামলাও করা যাবে না বলে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্থাবর সম্পত্তি হচ্ছে এমন সম্পদ যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা যায় না। যেমন জমি, ফ্ল্যাট, আবাসিক ভবন, শিল্পকারখানা বা জমিতে অবস্থানরত সম্পদ। আর অস্থাবর সম্পত্তি হচ্ছে স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ। যেমন অর্থ, অলঙ্কার, ঘড়ি বা অন্য মূল্যবান ধাতব পদার্থ। যেগুলো সহজেই স্থানান্তর করা যায়। সম্প্রতি ট্যাক্স অ্যামনেস্টির ইঙ্গিত করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বাজেটে এমন সুবিধা দেব, সবাই অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসবে।

ট্যাক্স অ্যামনেস্টির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে বাজেটে যে সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে পাচারকারিরা আরো উৎসাহিত হবে। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন। এরচেয়ে বড় বিষয় হলো- অর্থ পাচারকারীদের এ ধরনের সুবিধা দিয়ে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু আইনি কাটামো রয়েছে। এই আইনি প্রক্রিয়ায় না গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কেন এই অনৈতিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিগত বছরগুলোতে কালো টাকা সাদা করার সহজ সুবিধা দেয়া হলেও এমন সুবিধা এবারই প্রথম। করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দেয়া হয়। এতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সাদা করেন করদাতারা। এবার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতায় ইতোমধ্যে ডলারের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ধারাবাহিক কমছে টাকার মান। এই পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যাতে পাচার হওয়া অর্থ সহজে দেশে নিয়ে আসতে পারেন পাচারকারিরা।

বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অর্থ পাচার করলে অথবা অর্থ পাচারের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করলে সর্বনিম্ন ৪ বছর ও সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হলে অপরিশোধিত অর্থদণ্ডের পরিমাণ বিবেচনায় অতিরিক্ত কারাদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। পাশাপাশি আদালত অর্থদণ্ড বা দণ্ডের অতিরিক্ত হিসাবে দণ্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।

এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, নগদ, ব্যাংক আমানত এবং অন্যান্য সম্পদকে বৈধ করেছেন। তাদের অবৈধ সম্পত্তি বৈধ করতে গিয়ে মোট প্রায় ৯৩৯ কোটি ৭৬ লাক টাকা কর আদায় করেছে- যা দেশের স্বাধীনতার পর থেকে এক বছরের হিসাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ। আর ২০৫ জন শেয়ারবাজারে প্রায় ২৪০ কোটি কালো টাকা বিনিয়োগ করে সাদা বা বৈধ করেছেন। যেখান থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছে ২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর আগে দুই অর্থবছরে অর্থাৎ ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে করদাতারা মোট ৯১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করেছিলেন। যেখানে মোট করদাতার সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৮৩ জন। সর্বশেষ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১২২ জন করদাতা কালো টাকা বৈধ করেছেন। তারা মাত্র ১৫ কোটি টাকা সাদা করেছেন। এর বিপরীতে সরকার কর পেয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App