×

জাতীয়

শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত গাফফার চৌধুরী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ০২:৫২ পিএম

শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত গাফফার চৌধুরী

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে বিকেলে আনা হয় জাতীয় পতাকায় মোড়ানো আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কফিন। ছবি: ভোরের কাগজ

তিনি ছিলেন বাঙালির অমানিশার বাতিঘর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় অভিভাবক। যে কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির হৃদয় ছুঁয়েছিলেন সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেরুয়ারি’ গান গেয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতীক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে বিশ্বজনীন বাঙালি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। শনিবার (২৮ মে) বেলা সোয়া একটার দিকে ঢাকা জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহের কফিন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের মঞ্চে নেয়া হয়।

প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দীন। এরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল কবির আহমেদ শ্রদ্ধা জানান। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর শ্রদ্ধা জানান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপুমনি, আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিষ্টার বিপ্লব বড়ুয়া, ড. জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমীন হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, ড. মুহাম্মদ সামাদ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সংসদ অ্যারমা দত্ত, সাংবাদিক আবেদ খান, সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ, বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কলামিস্ট আব্দুল মান্নান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, অভিনয় শিল্পী রোকেয়া প্রাচী। শ্রদ্ধা নিবেদনকালে আরো উপস্থিত ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চার সন্তান ছেলে অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী এবং তিন মেয়ে তনিমা, চিন্ময়ী ও ইন্দিরা চৌধুরীসহ পরিবারের সদস্য ও নাতি-নাতনিরা।

[caption id="attachment_351499" align="aligncenter" width="700"] শনিবার বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের টেনিস গ্রাউন্ডে সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জানাজা সম্পন্ন হয়। ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় ১৪ দলীয় জোট, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ), ঐক্য ন্যাপ, ঢাকা জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ গণতন্ত্রী পার্টি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৃত্য শিল্পী সংস্থা, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, যুবমৈত্রী, ছাত্রলীগ (জাসদ) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ কবিতা পরিষদ, রফিক আজাদ স্মৃতি সংসদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, সংস্কৃতি মঞ্চ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, বাংলা বিভাগ ঢাবি, ওয়ার্ল্ড হিন্দু ফেডারেশন, খেলাঘর, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ন্যাশনাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, জাহানারা ফাউন্ডেশন জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ছায়ানট, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, প্রশিকা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন, ঢাকা কলেজ, জাতীয় হিন্দু মহাজোট, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, গণস্বাক্ষরতা অভিযান, পথনাটক পরিষদ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, প্রজন্ম একাত্তর, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, গ্রাম থিয়েটার, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, জাতীয় পার্টি, প্রমা আবৃত্তি পরিষদ, বৃত্ত নাট্যদল, ভিন্নধারা, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, ঢাকা ক্লাব, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, স্বণন, গণ আজাদী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি সংসদ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, উদীচী প্রভৃতি। শ্রদ্ধা নিবেদন বেলা তিনটা পর্যন্ত চলে।

[caption id="attachment_351461" align="aligncenter" width="700"] বিমানবন্দরে অমর একুশের গানের শব্দস্রষ্টা গাফফার চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ছবি: সংগৃহীত[/caption]

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে গাফফার চৌধুরীর সৃষ্টিকর্ম, রাজনৈতিক সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করবে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের কাছে বটবৃক্ষের মত ছিলেন। তার তুলনা তিনি নিজেই। মৃত্যুবরণ করলেও তিনি বেঁচে থাকবেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এই অমর গানের মধ্য দিয়ে। আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। তিনি দু:সময়ে এবং সংকটে পরামর্শ দিতেন।

দীপু মনি বলেন, আমাদের সকল আন্দোলন ও সংগ্রামে সাহস জুগিয়েছেন তিনি। কখনো মনে হয়নি তিনি দীর্ঘকাল প্রবাস জীবন-যাপন করছেন। তার কলাম যে আজকে থেমে গেলো, এটা দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অসাধারণ কলামিস্ট এবং একজন দেশপ্রেমিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ- বাঙালির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য তিনি সারাজীবন লিখেছেন এবং সারা জাতিকে উজ্জীবিত করেছেন।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, উনার চলে যাওয়ায় আমি মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। উনার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমরা সবকিছু খণ্ডিতভাবে লিখি, উনি সেটা ডিটেইলস লিখতেন। কারণ, ইতিহাস সম্পর্কে তার খুব পরিষ্কার জ্ঞান ছিলো।

 

আবদুল গাফফার চৌধুরীর ছেলে অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী বলেন, বাবা জানতেন এই দেশের মানুষ তাকে ভালোবাসে। এ কারণেই তার অন্তিম ইচ্ছা ছিল দেশের মাটিতেই সমাহিত হবেন। তার সেই শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে একমিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।

এরপর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আনা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গাফফার চৌধুরীর মরদেহ অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশেই শেষশয্যা নেন।

এর আগে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরীর মরদেহ দেশে এসে পৌঁছায় বেলা ১১টার দিকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এ সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান, শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম প্রমুখ।

গত ১৯ মে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গাফফার চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৮ বছর। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

বরিশালের উলানিয়া গ্রামের চৌধুরীবাড়িতে ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি একজন সুপরিচিত বাংলাদেশি গ্রন্থকার ও কলাম লেখক। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন চার মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। তার মেয়ে বিনীতা চৌধুরী ৫০ বছর বয়সে গত ১৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালে থেকেই মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছিলেন তিনি। বিনীতা চৌধুরী বাবার সঙ্গে লন্ডনের এজওয়ারের বাসায় থাকতেন এবং তাকে দেখাশোনা করতেন।

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেসকো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মানিক মিয়া পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গাফফার চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App