×

মুক্তচিন্তা

অপ্রতিঘাতের সংস্কৃতি হোক আমাদের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ০১:২৭ এএম

অতীত সব ধরনের দাঙ্গার সবটুকুই বাস্তবতা। এমন বাস্তবতার সামনে ভুক্তভোগী এবং শাসকশ্রেণির সামনে তিনটি অপশন খোলা থাকে- প্রত্যাঘাত করা, দাঙ্গাকে অস্বীকার করা অথবা স্বীকার করেই অপ্রতিঘাতের পথে চলা। কোনো অতীত দাঙ্গার স্মৃতি কিন্তু হারিয়ে যায় না, কারো কারো মধ্যে তা থেকে যায়। প্রশ্ন হলো, সেই স্মৃতি নিয়ে আমরা ঠিক কী করব? প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রত্যাঘাতের রাস্তাই হয়তো বেছে নিতে চাইবে। বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় থাকেন এক শ্রেণির মানবতাবাদী, যারা অনেকটাই অস্বীকার করতে চান দাঙ্গা বা সংঘর্ষের বাস্তবতা- যেন তেমন কিছুই হয়নি। এই দুই মেরুর রাস্তা একেবারেই বিপরীতধর্মী। প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রাণঘাতী, আর নীরবতার রাজনীতির বালিতে মুখ ঢেকে অস্বীকার করতে চায় ঝড়ো বাস্তবতা। এই দুটিতেই প্রশ্ন থেকে যায়। তাই তৃতীয় অপশনের পথ খুলে যায় সেই প্রশ্নের হাত ধরে। অপ্রতিঘাত। তবে পলায়নপর নীরবতায় নয়। চিকিৎসকের মতো প্রবেশ করতে হয় তাদের ব্যাধির মূল কারণে। দাঙ্গা মুহূর্তটি কেন, কীভাবে অনুষ্ঠিত হলো কিংবা অনুষ্ঠিত করানো হলো, তার চুলচেরা বিচার করে দাঙ্গার বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষকে, ভুক্তভোগীদের তা জানিয়ে অপ্রতিঘাতের মন্ত্র উচ্চারণ করেন তারা। মহাত্মা গান্ধীকে একদিন খুন করেছিলেন নাথুরাম। মহাত্মা গান্ধী কোনোদিনই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পাননি। হিন্দুত্ববাদী আততায়ীর গুলি হরণ করেছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রাণ। কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত গান্ধী বিদ্বেষ আর দাঙ্গার সত্যানুসন্ধানে প্রতিরোধে নেমেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের নোয়াখালী পর্যন্ত। নোয়াখালীতে মুসলমানের হাতে হিন্দু, বিহারে হিন্দুদের হাতে মুসলমান আক্রান্ত হয়েছিলেন। দুই জায়গাতেই গিয়েছিলেন গান্ধী। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কথা বলেছিলেন- দাঙ্গার ঘটনাকে তিনি অস্বীকার করেননি। ল²ীপুর থানার অধীনে বিজয়নগর গ্রামের বাসিন্দা পোস্ট মাস্টার প্রকাশচন্দ্র দাস মহাত্মা গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন- ‘যতই লিখি, ততই আবেগ বাড়িয়া উঠে।’ গান্ধী আর তার সহযোগীদের কাজই ছিল, এ আবেগ যাতে প্রতিহিংসার পথ প্রস্তুত না করে সেদিকে খেয়াল রাখা। আক্রমণ ও দাঙ্গার কারণ যে কেবল ধর্মই নয়, অর্থনৈতিক বটে- তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। টাকার লোভ, নারীমাংসের লোভ অনেকাংশেই দাঙ্গাকে জটিল ও শক্তিশালী করে তোলে। এখানে যা হয়েছে, তার প্রতিশোধ ওখানে; ওখানে যা হয়েছে, তার প্রতিশোধ আবার নতুন কোনো জায়গায়- এভাবে মানুষকে বর্বরতার নরকে ডুবতে দেখতে চাননি মহাত্মা গান্ধী। মহাত্মা গান্ধীর এমন রাজনীতি থেকে অনেক কিছুই শেখার ছিল এ দেশের মানুষের। যে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা করে সত্যাগ্রহের সূচনা করেছিলেন গান্ধী, সেই দক্ষিণ আফ্রিকায়ই নেলসন ম্যান্ডেলার হাতে বর্ণবিদ্বেষের কারাগার থেকে রাজনৈতিকভাবে মুক্তি পেয়েছিল দেশটি। সাদারা কালোদের ওপর যে বর্বরতা করেছে, সেই বর্বরতার পুনরাবৃত্তি যেন ক্ষমতাসীন কালোরা না করে সে বিষয়ে তিনি সচেতন সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গান্ধীর অপ্রতিঘাতের আদর্শ বাস্তব রূপ পেয়েছিল ম্যান্ডেলার কার্যক্রমে। মধ্যভূমির চেহারাটা কিন্তু মোটামুটি একই রকম থাকে- তা সে ইউক্রেনেই হোক বা বাংলাদেশের কুমিল্লা-গাইবান্ধাতেই হোক। তফাৎ শ্রেফ মাত্রার। ইউক্রেনে বোমার পর বোমা মেরে একের পর এক শহর ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে; নারী ও শিশুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বাড়ি; বোমা ও মিসাইলে অগ্নিশুদ্ধি হচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-গাইবান্ধাতেও পুড়ে খাক হয়েছে হিন্দুদের বাড়ি, অত্যাচারিত হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু। প্রাণহীন বাড়িগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে ভয়াবহ প্রতিহিংসাপরায়ণতার। দেশটি প্রজাতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক। আবার রাষ্ট্রের একটি ধর্মও আছে। একটু যেন গোলমেলে। তারপরও তো প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা এখনো বজায় আছে। প্রজাতন্ত্র বললে কেবল এটুকুই বলা হচ্ছে না যে, এ হলো প্রজার তন্ত্র বা শাসন। এ কথাও মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, আগে যে প্রজা ছিল রাজা বা রানির প্রজা, সে-ই এখন চালকের আসনে। শব্দটি যেন নিজেই এক পালা বদলের অভিজ্ঞান বয়ান করছে। কিন্তু রোমাঞ্চ একটু জুড়িয়ে গেলেই খটকা লাগে! এই জনগণ, ব্যাপারটা ঠিক কী গো? এতকাল ধরে পোড় খেয়ে আমরা এ দেশের জনগণ কি জানি- কারা আমাদের প্রজাতন্ত্রের ধারক, বাহক ও চালক? জানি কি, আমরা ঠিক কাদের প্রজা? এখনো কিন্তু ছায়া দেখতে পাই রাজা-রানিদেরই। রাজা-রানিদের বলয়ে আছেন কিছু সৌভাগ্যবান- সর্বকালে সর্বদেশেই থাকেন তারা। বাংলাদেশের জন্য সে উপাখ্যান নতুন কিছু নয়। তাদের সঙ্গে আছেন করপোরেট দুনিয়ার অতিকায় মালিকরা- রাজদণ্ডও যাদের সমীহ করে চলে, এড়িয়ে চলে কিংবা যাদের পরোক্ষ হুকুমে দেশ চালিত হয়। এমন ক্ষমতাবানদের সংখ্যা কিন্তু মাত্র এক শতাংশ, ক্ষমতাহীন প্রজারা সেখানে ৯৯ শতাংশ। মাঝখানে একসময় ছিলেন কিছু সম্মানিত প্রজা, কিন্তু এখন আর কেউ নেই। ওই দল হয় এখন ৯৯ শতাংশের অংশ, নয়তো-বা এক শতাংশের অংশ। সমস্যাটা কিন্তু নতুন নয় এবং কেবল আমাদের সমস্যাই নয়। ৯৯ শতাংশের নামে গণতন্ত্রের খোলস বানিয়ে এক শতাংশের ঘোড়া ছুটছে প্রবল বেগে, সামনেও ছুটবে এভাবেই। তাদের রাষ্ট্রে প্রজাতন্ত্রের প্রদর্শনী হবে; ৯৯ শতাংশের প্রজারা তা দেখে বিমুগ্ধ হবেন, বিমূঢ় হবেন অথবা সন্ত্রস্ত হবেন। এ রকম একটি প্রজাতন্ত্রের অবয়বে দেশের কিছু মানুষ কেবল তাদের ধর্ম পরিচয়ের কারণে প্রতিনিয়ত মাথার ওপরে একটি খাঁড়া নিয়ে দিনযাপন করছেন- সংখ্যাগুরুবাদের খাঁড়া। সব সময়ই ছিল এই খাঁড়া। তবে ১৯৭১-এর একটু আগে ও একটু পরে খাঁড়াটি একটু দূরে ছিল। তাকে প্রতিহত করার নানা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচও অনেকখানি কার্যকর ছিল। আজ দূরত্ব ঘুচে গিয়েছে, রক্ষাকবচ সরে গিয়েছে, মৌলবাদী শিবিরের রকমারি মঞ্চ থেকে ওদের শেষ করার হুঙ্কার ধ্বনিত হচ্ছে। আর সেই হুঙ্কারের সঙ্গে লয় হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতার অধীশ্বরদের প্রগাঢ় নীরবতা। সেই নীরবতায় হিংসার কারবারিরা বিপুলভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে, পেয়েই আসছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিশেষণটি এখনো বহাল আছে, যদিও সুবিধা বুঝলে হয়তো সংখ্যাগুরুর দাপটে তাকে একদিন ‘ফুঁ’-এর বাতাস দিয়ে বিদায় করবে। কিন্তু শব্দে কী এসে যায়! ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চিহ্নিত করে, নানা কৌশলে তাদের অধিকার হরণের আয়োজন করে, দেশপ্রেম নেই- পাশের দেশের ভক্ত তকমা লাগিয়ে, সরাসরি তাদের ওপর চড়াও হয়ে যাদের নীরবতায় কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ইন্ধনে মৌলবাদী রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই তাদের মধ্যে থেকে মাঝে-মধ্যে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে যে প্রেমের বাণী প্রচার করা হয়, তাতে মুখ লুকিয়ে নিজেই হেসে ওঠে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি। সুযোগ থাকলে এ শব্দটিই সংবিধানকে বলত- ‘এবার আমাকে ছেড়ে দাও, আর তো সহ্য হয় না।’ সংবিধানের বিশেষণের ফর্দটিতে বাকি থাকল ‘গণতান্ত্রিক’। পাঁচ বছর অন্তর অন্তর তার কথা নতুন করে বলার কি সুযোগ আছে? যদি ভাগ্যগুণে ভোট দিতে সক্ষম হয়ে যান, ভোট দিয়ে আসার পর এবং তার আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্ষমতাধারী অথবা ক্ষমতা সন্ধানীদের অর্থহীন আস্ফালন এবং কুৎসিত গালিগালাজ শোনা ছাড়া আমাদের গণতন্ত্র বলতে আর কী বোঝায়, প্রজার সম্ভবত জানা নেই। এই কি আমাদের পরিণতি? এই কি স্বাধীনতা লাভের পুরস্কার? আমাদের সব আছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেøাগান আছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা আছে, গণতন্ত্রের বড় বড় যুক্তি আছে, সরকার আছে, বিরোধী দল আছে, রাজনীতির চর্চা আছে। তারপরও কী যেন নেই! সেই না-থাকাটা যা আছে, তাকে যেন একেবারেই আড়াল করে দিচ্ছে। কুমিল্লায় দেবতার মন্দিরে ঢুকে যাচ্ছে মৌলবাদী শক্তি, দেবতার পায়ে কুরআন রেখে দিয়ে দোষ চাপাতে চাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর। আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশের সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি এবং মন্দিরে। পুড়িয়ে মারছে নিরীহ মানুষগুলোকে। তারপরও আমরা নীরবতার পথই বেছে নিচ্ছি। ওটাই বুঝি সমাধানের একমাত্র পথ? প্রজাতন্ত্রকে কি তা নত মস্তকেই মেনে নিতে হবে? ঘটনার গভীরে কেউ যাবে না? গান্ধীজি, নেলসন ম্যান্ডেলা সেই কবে এমন ঘটনাগুলোর গভীরে গিয়েছিলেন। তারা মুখ লুকিয়ে পাশ কাটিয়ে যাননি। রীতিমতো চিকিৎসকের মতো ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই তারপর সংশ্লিষ্টদের কাছে অপ্রতিঘাতের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। প্রতিহিংসা নয়, নীরবতাও নয়- বরং দীক্ষা দিয়েছিলেন অপ্রতিঘাতের। সেভাবে এগিয়ে যেতে পারিনি আমরা। হিংসা-প্রতিহিংসায় জ্বলছে আমাদের দেশ। প্রজাতন্ত্রও নত মস্তকে মেনে নিয়েছে সবকিছু। প্রজাদের একজোট করে দাঁড়াতে সাহায্য করেনি কেউ। দাবি ওঠেনি, আমাদের ‘তন্ত্র’ আমরাই তৈরি করব- যেখানে ‘রাজ’ করবে আমি, তুমি এবং ৯৯ শতাংশ। গড়ে উঠেনি সেভাবে আমাদের সংস্কৃতি আর নীতি। গড়ে উঠেনি সেভাবে আমাদের রাজনীতি। কেননা অপ্রতিঘাতের সংস্কৃতি, নীতি বা রাজনীতি গড়ে তুলতে যা সবচেয়ে প্রয়োজন, সেই প্রজাদের ৯৯ শতাংশকেই দূরে রেখে সবকিছু ঘটেছে। তাদের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি, শিক্ষা দেয়া হয়নি কিংবা বুঝতে দেয়া হয়নি অপ্রতিঘাতের মহিমাকে। সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App