×

মুক্তচিন্তা

পিরিয়ড লজ্জা নয় সচেতনতা প্রয়োজন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২২, ১২:৩৬ এএম

পিরিয়ড শুধু একটি মেয়েলি বিষয় নয়, একটি সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা, লজ্জার কোনো বিষয় নয়। বর্তমানে শহরে পিরিয়ড বিষয়টি নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে খোলামেলা আলোচনা হলেও, গ্রামে এখনো এই ট্যাবু থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ফলে কিশোরী ও নারীরা পিরিয়ড ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানসম্মত উপায় সম্পর্কে যেমন জানতে পারে না, তেমনি লজ্জা-সংকোচের কারণে এ বিষয়ক চাহিদার কথাও পরিবারের সদস্যদের কাছে খোলামেলাভাবে বলতে পারে না। যে কারণে সমাজে পিরিয়ড নিয়ে প্রচুর কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে ও চর্চিত হয়। পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার পুরনো কাপড় ব্যবহার করলে জ্বর, তলপেটে ব্যথা ও মূত্রনালিতে সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া জরায়ুতে ইনফেকশন হতে পারে। ইনফেকশন দীর্ঘদিন থাকলে পরবর্তীতে সেটি জরায়ুর ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পুরনো, অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারে পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তপাতের সম্ভাবনাও থাকে। পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি প্যাড বা কাপড় যেটাই ব্যবহার করা হোক না কেন, সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়কেই গুরুত্ব দেন চিকিৎসকরা। পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় পরিচ্ছন্ন থাকার বিকল্প নেই। এ সময় কাপড় বা প্যাড ব্যবহার করার পূর্বে অবশ্যই হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। যাতে হাতের জীবাণু কোনোভাবেই কাপড় বা প্যাডে না লাগে। অন্যদিকে পিরিয়ডের সময় রক্ত খুব বেশি গেলে তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি সময় একই প্যাড ব্যবহার অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর যদি কম রক্তপাত হয়, তবে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। আবার অনেকেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘন ঘন পরিবর্তন করেন। সেটাও সঠিক উপায় নয়। স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের পর বাকি প্যাডগুলো উন্মুক্তভাবে বাথরুমে রেখে দিলে বাতাসে থাকা জীবাণু প্যাডে সংক্রমিত হয়, যা কিনা সাধারণ চোখে দেখা যায় না; কিন্তু স্যাঁতসেঁতে জায়গায় জীবাণু দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার ফলে উন্মুক্ত স্থানে থাকা প্যাড ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেক গুণ। ফলে প্যাড পরিষ্কার বা কোনো বন্ধ জায়গায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। পিরিয়ডের সঙ্গে শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, এর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যও জড়িত। এ সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকার ফলে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। তাই পিরিয়ড নামের এই ট্যাবুকে স্বাভাবিক করে, মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথ সুগম করে দেয়ার জন্য পরিবারের বয়োসন্ধি উপযুক্ত ছেলেমেয়ে উভয়কেই এই ব্যাপারে অবগত করা প্রয়োজন। পিরিয়ড স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে নানানভাবে কাজ হলেও, বাস্তবায়নে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। পাঠ্যপুস্তকে মাধ্যমিক পর্যায়ে পিরিয়ড সংক্রান্ত একটি আলাদা চ্যাপ্টার থাকলেও তা যথাযথভাবে পড়ানো হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, নয়তো বাড়িতে পড়ে নিতে বলা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেসরকারি কো এডুকেশন বিদ্যালয়গুলোতে পিরিয়ড-বান্ধব টয়লেট করার উদ্যোগ নেয়া হলেও অধিকাংশ স্কুলই বাজেট না থাকাকে টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণ চালু রাখা এবং সাবান ও পিরিয়ড উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে মনে করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে, চরাঞ্চল বা পাহাড়ি অঞ্চলে এখনো এক কাপড় বারবার ব্যবহার করা হয়। অনেক পরিবার ২০০-২৫০ টাকা দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে চান না, অনেকের জন্য এটি বাড়তি ব্যয়, আবার কারো কারো সামর্থ্য থাকে না। যে শিক্ষার্থীরা কাপড় ব্যবহার করে, তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের কথা বললেই হবে না, এটার সঠিক ব্যবহার, ব্যবহারের পর কোথায় ফেলতে হবে- এই বিষয়গুলোও জানাতে হবে। ন্যাপকিন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এলেই কেবল এর ব্যবহার বাড়বে। তবে শুধু বাজেটে ন্যাপকিনের দাম কমানো নয়, এর ম্যাটেরিয়ালগুলোর বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। পাটের আঁশ, ঝুট থেকে শুরু করে নানান প্রাকৃতিক বস্তু দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানোকে উৎসাহিত করতে হবে। পিরিয়ড ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে, এতে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। স্কুলের শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সাবসিডি দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। স্কুলগুলোতে প্যাড ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বিনা পয়সায় অথবা নামমাত্র মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে সক্ষম হয়। এছাড়া প্রয়োজনে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ভেন্ডিং মেশিন বসানো যেতে পারে, যাতে দোকানি ছাড়াই প্রয়োজনে প্যাড কিনতে পারা যায়। আমাদের কমিউনিটি পর্যায়ে কথা বলতে হবে। সামাজিক বিপ্লব গড়ে তুলতে হবে। পিরিয়ডের বিষয় স্বাভাবিক করতে হলে, পরিবারের সবাইকে এই আলোচনায় আনতে হবে। বুঝতে শিখার পর থেকেই মেয়ে শিশু এবং ছেলে শিশু উভয়কেই শারীরিক পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করতে হবে। যাতে সামাজিক এই ট্যাবুগুলো থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে এবং নিজেরাই এই বিষয়গুলোকে সামাল দিতে পারে। কারণ বিষয়টি শুধু একটি মেয়েরই না, যে কোনো পরিবেশে একজন নারী যেন তার পিরিয়ড প্রসঙ্গে কথা বলতে পারে, তাই ছেলেদের এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এ সময়ে মেয়েদের পুষ্টিকর খাবার দেয়ার বিষয়টিতে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কারণ পিরিয়ডের সময় রক্তক্ষরণের ফলে তাৎক্ষণিক এবং ভবিষ্যতে নানান স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। পিরিয়ড যেহেতু যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যেরই একটি অংশ, তাই মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পিরিয়ডকে স্বাস্থ্যসম্মত ও ইতিবাচক হিসেবে দেখার পরিবেশ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রামের পাশাপাশি বস্তি অঞ্চলের ওপরে বিশেষ জোর দিতে হবে। সেজন্য সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মাধ্যমে নানান প্রকল্প চালু করা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।

সাবিনা স্যাবি : গণমাধ্যমকর্মী [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App