×

জাতীয়

‘নদী’ কনফারেন্স ঘিরে ফের আলোচনায় তিস্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২২, ০৮:১১ এএম

‘নদী’ কনফারেন্স ঘিরে ফের আলোচনায় তিস্তা

বাংলাদেশ-ভারত

‘নদী কনফারেন্স’ ঘিরে ফের ভারত ও বাংলাদেশের আলোচনার টেবিলে উঠতে চলেছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি। আগামী ২৮ ও ২৯ মে আসামের গুয়াহাটিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এই কনফারেন্স হতে যাচ্ছে। এতে অংশ নেবেন ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এই প্রথম বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজধানীর বাইরে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কোনো একটি অঙ্গরাজ্যে বৈঠক করছেন। ভারত-বাংলাদেশের পাশাপাশি এই বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন প্রতিবেশী কিছু দেশের প্রতিনিধিরাও।

এছাড়া আগামী ৩০ মে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সপ্তম জেসিসি বৈঠক। ঢাকার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও নয়াদিল্লির পক্ষে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এতে নেতৃত্ব দেবেন। বৈঠকে উভয়পক্ষের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিশেষ করে বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, পানি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যুসহ নতুন নতুন অনেক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয় উঠে আসবে। ঢাকার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সফর চূড়ান্ত করাসহ হাজার হাজার কোটি টাকা আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দেশটিতে গ্রেপ্তার পি কে হালদারকে বাংলাদেশে দ্রুত ফেরত আনতে নয়াদিল্লির সহযোগিতা চাওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গুয়াহাটিতে ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ফরমেটের আয়োজনে দুদেশের এজেন্ডাভিত্তিক কোনো আলোচনা হবে না। তবে সাইডলাইনে হয়তো উভয়পক্ষ পানি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। তবে এটা ঠিক, তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আবার নতুন করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে- সেটা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তবে গুয়াহাটির বৈঠকে শুধু তিস্তা নয়, মনু, ধরলা, দুধকুমার, গোমতি, খোয়াই ও মুহুরি নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি সিলেট সীমান্তে কুশিয়ারা নদী থেকে বাংলাদেশ যাতে পানি তুলতে পারে

সে বিষয়টিও আলোচনায় থাকবে। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ বছর ভারতে আসার জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি চূড়ান্ত হওয়ার আগে গুয়াহাটিতে নদী কনফারেন্স এবং ৩০ মে নয়াদিল্লিতে জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক, আগামী জুনে ঢাকায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হতে পারে। এজন্য দিল্লি থেকে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রীর ঢাকা সফরের কথা রয়েছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে বৈঠকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ওরা আমাদের দাওয়াত দিয়েছে। আমরা অংশ নেব। সেখানে হয়তো দুই দেশের নদী কানেকটিভিটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমরা চাইব, কীভাবে নদীপথে কানেকটিভিটি বাড়ানো যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, দ্বিপক্ষীয় এজেন্ডায় যা যা আছে সবই থাকছে। ট্রেড আছে, কানেকটিভিটি আছে, কমার্স সেক্টর কো-অপারেশন, ওয়াটার কানেকটিভিটি আছে; সেখানে তিস্তা, কুশিয়ারা, ছয়টি অভিন্ন নদীসহ সব থাকবে। আরো অনেক নতুন নতুন ইস্যু আছে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে- আইসিটি রয়েছে, ফুড সিকিউরিটি রয়েছে, রিনিউয়েবল এনার্জি, ক্লাইমেট ইস্যু আছে। এবারের বৈঠকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো সুখবর থাকছে কিনা- জানতে চাইলে সচিব মাশফি জানান, এখন বা এ বৈঠকে কোনো সুখবর পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি সপ্তম জেসিসিতে কোনো এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক সইয়ের সম্ভাবনাও নেই বলে জানান তিনি। যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মো. মাহমুদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনার কী আছে বুঝতে পারছি না। গত ১১ বছর ধরে আমরা এই চুক্তি সাক্ষরের অপেক্ষায় আছি।

জানা গেছে, নরেন্দ্র মোদি সরকার তিস্তার বাস্তব চেহারা শেখ হাসিনা সরকারকেও জানিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার কাছে তিস্তার পানি যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশে তিস্তার দুপারের চাষিদের সেচের পানি সরবরাহ করা। শেখ হাসিনা ও মোদি সরকার একাধিকবার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা করেছেন, চাষিদের সেচের পানি দেয়ার উপায় কি এবং কিভাবে এই তিস্তার পানি সরবরাহ করা যায় ও তিস্তার শুকনো ছবি কি করে বদলে দেয়া যায়। কারণ তিস্তা শুকনো থাকার কারণে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। হাসিনা সরকার ও মোদি সরকার সচেষ্ট কীভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে দুই দেশের মধ্যে পানি সরবরাহ রাখা যায় এবং চলতি সমস্যার সমাধান করা যায়। রাজনীতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। আর সে কারণেই এই আসামের গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নদী কনফারেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুই দেশ শুধু তিস্তা নয়; অন্য একাধিক নদীর চেহারা এবং তার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয় ছাড়াও নদীর পানি কিভাবে দূষণ মুক্ত করা যায় সে বিষয়েও আলোচনা করবে। দরকার হলে নদী দূষণ রুখতে দুই দেশ একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার রূপরেখা তৈরি করে নিয়ে এই কনফারেন্সে উপস্থিত হবে বলে জানা গেছে ঢাকা ও দিল্লির একাধিক সূত্র থেকে।

চুক্তির টেবিলে পৌঁছে যাওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ১১ বছর ধরে তিস্তা চুক্তি হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফরে গিয়ে বেঁকে বসেন মমতা। সেই থেকে ঝুলে আছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেকার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তীকালে তিস্তার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নদী কমিশন গঠন করেন। কিন্তু সেই রিপোর্ট আজো প্রকাশ্যে আসেনি। কখনো মুখ খোলেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিংবা সেখানকার নদী কমিশনের চেয়ারম্যান। তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে নয় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বক্তব্য, চুক্তি হলেই তো হবে না। চুক্তি মোতাবেক পানি বাংলাদেশকে দিতে হবে কিন্তু নদীতে পানি নেই, তাহলে এই চুক্তি করে লাভ কি। তবে সেই থেকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে কার্যত ভিলেন হয়ে গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিগত ১১ বছরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে মমতার। বাংলাদেশের তরফ থেকেও কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এসব আলোচনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার একই কথা বলেছেন- তিস্তায় পানি কোথায়, বাংলাদেশকে চুক্তি করে দেবেন?

গবেষকরা বলেছেন, তিস্তা নদী সিকিম হিমালয়ের ৭ হাজার ২শ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে সৃষ্টি হয়ে দার্জিলিং এর শিবা নামে পরিচিত একটি গিরি সংকটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সেবাকে করোনেশন সেতু পেরিয়ে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা পেরিয়ে বাংলাদেশের রংপুর জেলার মধ্যে দিয়ে তিস্তা মিশেছে ব্রহ্মপুত্র নদীতে। সিকিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় তিস্তা নদী অনেকগুলো গিরিখাত সৃষ্টি করেছে। তিস্তার পথে নানা ধরনের বনভূমি দেখা যায়। তিস্তা ভয়ংকর চেহারা নেয় বর্ষাকালে। বৃষ্টি নামতেই তিস্তার দুপাশের অঞ্চল ছাপিয়ে বন্যা হয়। এই সময় তার আশপাশের পাহাড় ধ্বস নামতে দেখা যায়।

১৭৮৭ সালের আগে তিস্তা নদী পূর্বে করোতোয়া ও পশ্চিমের পুনভর্বা ও আত্রাইয়ে গিয়ে মিলিত হতো। সে সময় পুনর্ভবা মিলিত হত মহানন্দায়। আত্রাই চলন বিলে উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ায় গিয়ে মিলিত হতো। পরে আত্রাই করোতোয়ার যুগ্ম ধারাটি জাফরগঞ্জ এর কাছে পদ্মায় মিলিত হয়। ১৭৮৭ সালের এক বিধ্বংসী দুর্ঘটনার পর তিস্তা তার পুরনো গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মেশে। সমস্যার শুরু হয় তখন থেকেই।

১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে স্থির হয় তিস্তা নদীর পানির ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে তখন কোনো নির্দেশনা তৈরি করেনি দু’দেশ। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ২৫ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দু’দেশের মধ্যে ভাগ করে অবশিষ্ট কুড়ি শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত করার প্রস্তাব দেয়। ভারত তখন এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নীলফামারীতে তিস্তা নদীর উজানে এবং পশ্চিমবঙ্গ জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গাজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে। এর বাইরে আছে সিকিমে নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ফলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের ক্ষতি হয়। এতে তিস্তার চেহারা বদলে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে চর জেগে ওঠেছে। কমেছে নদীর নাব্যতাও। ফলে বর্ষার মৌসুমেও দেখা যায় নদীর বিভিন্ন জায়গার চর জেগে আছে। আর শুকনো মওশুমে নদীর পেটে ঢুকে বালি পাথর তোলে ট্রাক খেলা করে ছেলেমেয়েরা। শুকনো মওসুমে তিস্তার পানি না পেয়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় বাংলাদেশ।

পশ্চিমবঙ্গ চায় তিস্তার পানি দিয়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে; আর বাংলাদেশ চায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের পানি দিক তিস্তা। এই ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য নদীর পানি দিতে গেলে শুকনো মওশুমে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে যত ঘনমিটার পানি থাকা দরকার, তা থাকে না। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে এই পানি দিতে গেলে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে ১৬শ ঘন মিটার পানি থাকা দরকার। অথচ তখন প্রতি সেকেন্ডে তিস্তার পানি থাকে মাত্র দেড় থেকে দুইশ ঘন মিটার। সিকিমের উপরে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ছাড়া পানি পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা ব্যারেজ ধরে রাখতে পারে না। অর্থাৎ সেচের জন্য তিস্তার কাছে যতটা পানি প্রত্যাশা করা হচ্ছে বাস্তব অবস্থায় সেই পানি নেই বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এই তিস্তা চুক্তিতে আপত্তি করেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর আগে বলেছেন, তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিতে গেলে নতুন করে নদী পানি প্রবাহেরপথ তৈরি করতে হবে; কিংবা তিস্তা নদীসহ চারপাশের নদীগুলো খনন করতে হবে। নইলে এই পানি বাংলাদেশে গিয়ে পৌঁছবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App