×

মুক্তচিন্তা

কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট প্রয়োজন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২২, ১২:৫৮ এএম

কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট প্রয়োজন

বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। অর্থনীতিতে একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট। দেশের ন্যায় মানুষেরও দৈনন্দিন জীবনে একটি বাজেট থাকে। তবে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাজেটের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। ব্যক্তি ব্যয় করেন আয় অনুসারে, অপরদিকে সরকার বা রাষ্ট্র আয় করে খরচ অনুসারে।অন্যদিকে অর্থনীতির পরিভাষায়, কর্মসংস্থান বলতে চাকরি করা বা কর্মরত থাকা অবস্থাকে বোঝায়। একজন ব্যক্তি যখনই কাজ করবে তার আয় বাড়বে এবং সঙ্গে তার ক্রয়ক্ষমতাও বেড়ে যাবে। একটি সুষম বাজেট হয় দেশের উন্নয়নের জন্য। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) মূল বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যেখানে জিডিপি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছে ২০১৭ সালে। প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, দেশে ৬ কোটি ৮ লাখ লোক কাজের মধ্যে ছিলেন। ২০১৩ সালে যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। এর মানে, ওই চার বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৭ লাখ। অর্থাৎ বছরে গড়ে পৌনে ৭ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। করোনা ভাইরাসের কারণে সেই সংকট আরো বেড়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করেন। এদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যমতে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ ২০২২ সালে বেকার থাকবে। যা মহামারি-পূর্ব সময়ের তুলনায় অন্তত ৫ লাখ বেশি। এছাড়া দেশে বেকারত্বের হার ২০২২ সালে বেড়ে ৫ শতাংশে দাঁড়াবে। যা মহামারি-পূর্ব সময়ের চেয়ে ০.৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় এসেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। এদিকে পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্টের জরিপের তথ্য বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে মার্চে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ তাদের বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার সামর্থ্য তলানিতে নামছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বলছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে প্রায় ৪১ ভাগ মানুষ। ২০১৯ সালে এটা ছিল ২০.৫ ভাগ। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেশে বেকারত্বের যখন এই অবস্থা তখন শোনা যাচ্ছে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। আমাদের জিডিপি যেটুকু বেড়েছে সে হারে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়েনি। বর্তমানে যে জিডিপি নিয়ে আমরা কথা বলি, তা কর্মসংস্থানবান্ধব নয়। লাখ লাখ যুবক বর্তমানে চাকরি হারা, বেকার এবং প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সংযুক্ত হতে পারছে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আগামী বাজেটসহ পরবর্তী বাজেটগুলোতে সুস্পষ্ট নজরদারি থাকা উচিত। এক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেমন- প্রথমত, বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। কারণ বিনিয়োগ বাড়লে নতুন শিল্প কারখানা হবে যেখানে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে। করোনা-পরবর্তী বিনিয়োগ পরিবেশ স্বাভাবিক করতে হলে এর বিকল্প নেই, অন্যথায় বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে না। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তা দিতে হবে। দেশের মোট শিল্প খাতের ৮৬ শতাংশই কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প। দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ১২২,৩১৫। এ জাতীয় ছোট খাতগুলোতে কাজ করছেন ৮৫১,৪৪০ জন মানুষ, এর মধ্যে নারী আছেন ৪.৩৮ লাখ জন। তাই এই শিল্পকে সহায়তা দিলে বেশি কর্মসংস্থান হবে। তৃতীয়ত, উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে কাজের প্রসার ঘটাতে পারলে সেখানেও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহজ শর্তে এবং স্বল্পসুদে ঋণ দিতে হবে এবং ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর ঋণ ব্যবস্থার তদারকি বাড়াতে হবে। ব্যাংকের কৃত্রিম আয় বন্ধ করে বিনিয়োগের হার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সব শেষে, করোনা মহামারি পরবর্তীতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বাজেট গতানুগতিক না হয়ে ব্যতিক্রম বাজেট হওয়া উচিত। বাজেট হওয়া উচিত কর্মসংস্থানবান্ধব। অর্থনীতির ভিত টেকসই করতে হলে অভ্যন্তরীণ কৃষি, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধিসহ ক্রমান্বয় আমদানি কমানোর পরিকল্পনা নিতে হবে, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অতএব এবারের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত।

রকিবুল হুদা মজুমদার : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App