×

মুক্তচিন্তা

মুখদোষ মন্ত্রীদের : মেজবান নষ্ট সরকারের

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২২, ১২:৩৮ এএম

বাকস্বাধীনতার নামে যার যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছেন। মন্ত্রী-নেতাদের এ স্বাধীনতাটি আরো বেশি। স্পেস-ফোরাম এবং প্রচার বেশির সুযোগে তারা বলতে লাগলে আর থামতে চান না। মন যা চায় বলেই যাচ্ছেন। তাদের যে কথা বলতে আগ-পিছ বেশি ভাবতে হয় বা ভাবা দরকার, আমলে নেয়ার গরজ মনে করেন না। তা করলে এমন সব কথা আসে? যেসব কথায় নষ্ট বা তলানিতে পড়ে যাচ্ছে সরকারের প্রশংসিত হওয়ার মতো এক একটি কাজ। রাজনীতির ময়দান সরকারের কাজের চেয়ে মন্ত্রীদের কথা নিয়ে সরগরম থাকছে বেশিরভাগ সময়। মুখদোষে ছেঁচা, মুখদোষে মেজবানি নষ্ট- এমন কয়েকটি আঞ্চলিক প্রবাদ রয়েছে দেশের কোথাও কোথাও। কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় এগুলোর উচ্চারণ বেশি। প্রবাদগুলোর অর্থ একদম সোজা-সাবলীল। তেমন দোষ না করেও কেবল উল্টাপাল্টা কথার কারণে মার খাওয়া বা দাওয়াতে উত্তমমানের খাওয়ানোর পর কটু কথায় মেহমান বেজারের ঘটনাদৃষ্টে স্মরণ করা হয় প্রবাদগুলো। কয়েক মন্ত্রীর ভেজাল কথায় বর্তমান সরকারের অবস্থাও কিছুটা সে রকম। তাদের কয়েকজনের অহরহ স্থূল কথায় একের পর এক গণ্ডগোল পাকছে। বিএনপি আমলে এক মন্ত্রীর পরিচিতি দাঁড়িয়েছিল ‘লুকিং ফর শত্রæজ’ নামে। আরেক মন্ত্রীর ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’ মন্তব্য ঘুরেছে মানুষের মুখে মুখে। ভাগ্যিস ওই সময় ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল আবিষ্কার হয়নি। বর্তমান সরকারের টানা সোয়া দুই যুগে ওই টাইপের মন্ত্রী-নেতা, বক্তা গজিয়েছেন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় হাজারেরও বেশি মানুষের করুণ মৃত্যুসহ বিভীষিকাময় সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ‘শিবিরের ধাক্কায়’ ভবন ধসের তথ্য দিয়ে আলোচনার খোরাক হয়েছিলেন। তিনি এখন মন্ত্রিত্বে নেই। কিন্তু মুখপাণ্ডিত্যে তার অনুসারী প্রচুর। মেধা-শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, সততার কোনো প্রশ্ন নেই। সিনিয়র-জুনিয়রও বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় বা দলীয় সিনিয়ররাও জুনিয়রদের সঙ্গে পেরে উঠতে গিয়ে লিপ্ত হচ্ছেন এ প্রতিযোগিতায়। সুফলও পাচ্ছেন। এক এক ঘটনায় হাতেনাতে প্রমাণ হচ্ছে মুখের জোরের বরকত। ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষার বদলে নিম্নমানের কথার বিষে কেউ কষ্ট পাচ্ছে বা পাবে এটি মোটেই এখন আর ভাবনার বিষয় নয়। বিষয়-আশয় অন্যখানে। মুখ বা থোঁতার জোরের এই সংস্কৃতি রাজনীতির মাঠ গড়িয়ে এখন অন্যদেরও পেয়ে বসেছে। অবস্থাটা দিনে দিনে এমন জায়গায় ধেয়ে চলছে, ফুটপাতের ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, মসজিদের ইমাম-খতিব, মন্দিরের ঠাকুর-পুরোহিত পর্যন্ত। কাজের চেয়ে মুখপাণ্ডিত্য রপ্ত করতে মনোযোগী। যে যেখানে যা পারছেন করে ছাড়ছেন। সত্য-মিথ্যা, ভদ্রতা-চাতুরি, বিনয়-অসভ্যতা, মমতা-নিষ্ঠুরতাসহ প্রায় সবই এখন আপেক্ষিকতায় ঠাসা। মুখের সঙ্গে তাদের শরীরী ভাষাও সেই বার্তাই দিচ্ছে। কখনো কখনো তারা এক সময়ের টেলিসামাদ, দিলদার, আনিস, হাবা হাসমতদের মতো বিনোদন দিয়ে ছাড়ছেন। মানুষ বিনোদিত হলেও, তাচ্ছিল্য করলেও ক্ষমতার জোসে তারা বিশেষ আদাব-সালাম, যতœ-আত্তি আদায় করে নিচ্ছেন। ঘুষকে স্পিড মানি, দুর্নীতির সঙ্গে যানজটকে উন্নয়নের প্রমাণ, জনভোগান্তিকে উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো বচনে জায়েজ করার আর হেন কিছু বাকি রাখেননি। নইলে কী করে একজন মন্ত্রী বলে বসেন, বহু দেশের মানুষেরই বিমানে চড়ার সামর্থ্য নেই, সেখানে আমরা প্লেনে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসি? বিদেশের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য বসে থাকে- এই গর্ব জানান দিয়েছেন আরেক মন্ত্রী। তাদের এ কিসিমের কথায় মোটা দাগে প্রশ্নবিদ্ধ হয় গোটা সরকার। মøান হয় সরকারের বড় বড় অর্জন। এর আগে করোনাকালে কয়েক মন্ত্রীর বচন বর্ষণ চলেছে। ‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী’ বলে বাঙালি জাতিকে ভাইরাস জাতে নিতেও ছাড়েননি তারা। সাম্প্রতিক সময়ে তেলের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে তাদের তত্ত্ব এবং কথামালার উৎসব। পরিকল্পনামন্ত্রী নতুন মাত্রা যোগ করে বলেছেন, তার ডানা কেটে দেয়া হয়েছে। সহকর্মীরাও তাকে ‘ডানাকাটা মন্ত্রী’ বলে মশকরা করছেন। এর নেপথ্য হচ্ছে- এর আগে তিনি যে আনলিমিটেড পরিমাণের প্রকল্প অনুমোদন দিতে পারতেন, একনেকের ওই সভায় তা কমিয়ে তার ক্ষমতা ৫০ কোটি করা হয়েছে। এতে হতাশার সুরে বলেছেন, তার ডানা কেটে ফেলা হয়েছে। নিত্যপণ্যের সঙ্গে অতিকথনের বাজার গরম হয়ে ওঠায় অভিধানও পাল্টে যাওয়ার দশা। একই বিষয়ে আজ এক কথা, কাল আরেক কথার চাতুরি। এই চাতুরি এখন একটা স্মার্টনেস। মিথ্যাচারীর প্রতিশব্দ ‘সুবক্তা’। এদিকে-সেদিকে ঢুঁ মারলে আগে বলা হতো ডিগবাজি। হাল আমলে তা চমক-ক্যারিশমা। এক একটি ঘটনায় মানুষের কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো কথার তীর আসছে এই চমক ও স্মার্টনেসধারীদের কাছ থেকে। কোনো ছাড় দেয়া হচ্ছে না তেল-চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের কষ্টের সময়টাতেও। সয়াবিন তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কেউ জানতেও চাইল না এতদিন এই ক্ষতিকর পণ্যটি খাওয়ালেন কেন জনাব? নানা বদনাম দিয়ে সরিষার তেলকে ধাওয়ালেন কেন? ড্রাইভারদের মানুষ চেনার দরকার নেই, গরু-ছাগল চিনলেই চলে- এমন কথা একজন মাননীয় কী বলতে পারেন? জি পারেন। পারেন বলে পেরেই আসছেন। পারছেন বলেই তো এই কঠিন দিনেও বলে চলছেন- উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে। সকালে ঘুম থকে উঠেই মানুষ দেখে তার মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে। ঢাকার টয়লেটগুলো ফাইভস্টার হোটেলের মতো। হাতিরঝিল গেলে মনে হয় প্যারিস শহর, আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে মনে হয় লস অ্যাঞ্জেলস। আগামীতে টেমন নদী দেখতে লন্ডন নয়- বুড়িগঙ্গা গেলেই হবে। দেশে চালের কোনো সংকট নেই, মানুষ ভাত বেশি খায় বলে চালের দাম বাড়ছে, ডায়াবেটিসও বাড়ছে, গরুও এখন ভাত খায়, গরু কচুরিপানা খেতে পারলে মানুষ কেন তা খেতে পারবে না-ধরনের দু-চারটা কথায় মানুষের মনে কষ্ট গেলেই বা কী? বারবার সিঙ্গাপুর-লন্ডন থেকে মেডিকেল চেকআপ করে ফিরে তারা দিচ্ছেন মানুষকে চিকিৎসার জন্য বাইরে না গিয়ে দেশপ্রেমের সাক্ষর রাখার পরামর্শ। তাদের জন্য কথার মাঠ যেন ফাঁকা। এক একটা কথার মেশিন থেকে শব্দ বের হওয়া মাত্রই প্রচার। গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম। গত প্রায় সোয়া এক যুগে এই মান্যবরদের বচনগুলো নিয়ে একটি বই সংকলন করলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুখপাঠ্য হতে পারে। তারা জানতে পারবে, এ দেশটিতে একদা কিছু রাজমান্যবর ছিলেন। যাদের ছিল কথার খ্যাতি। কথা দিয়ে জাতিকে কত বিনোদন দিতেন তারা! এ ধরনের এক কথা ঢাকতে আরেক কথার পিটুনিতে রাজনীতির মাঠ উতরানো যায়। দেশে চলে। কিন্তু কূটনীতির মাঠে অচল। কূটনীতির ময়দানটা স্পর্শকাতর। জবাবদিহি আছে সেখানে। আগপিছ ভাবতে হয়। যার একপশলা সম্প্রতি দেখিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। ভারতে গ্রেপ্তার বাংলাদেশের পি কে হালদারকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তার বক্তব্য, ‘এটি আইনি বিষয়। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে জানানো হবে। বুঝতে হবে, এটি কিন্তু বড়দিনের কার্ড বিনিময় নয়।’ কী শিক্ষা এবং বার্তা দিলেন দোরাইস্বামী! অথচ একই দিনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ভালো খাবারের আশায় ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে আসছে। গত ১২ বছর ধরেই অনেক রোহিঙ্গা উদ্বান্তু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থান করছেন। কিন্তু ভারতের খাবার তাদের মনঃপুত নয়। তাই তারা ভালো খাবারের আশায় বাংলাদেশে আসছে। একজন হাইকমিশনার আর একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা পাশাপাশি ফেললে তফাৎটা বুঝতে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। সাধারণ বুঝজ্ঞানেই যথেষ্ট। একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাখ লাখ অসহায় মানুষের দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলাকে ভালো খাবারের প্রতি আকর্ষণের সঙ্গে মিলিয়েছেন। তাও কোন দেশ? যে দেশ একাত্তরের চরমদিনে আমাদেরই এক কোটি মানুষকে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ ভালো খাবারের আশায় গিয়েছিল ভারতে? এই মন্ত্রীই আবার বছরখানেক আগে ভারতের প্রশংসা করতে গিয়ে বলে দিয়েছেন, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এক এক বেলায় এক এক সস্তা-খুচরা কথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলে বা চালানো যায়। অন্য কোথাও নয়। কূটনীতিতে মোটেই নয়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App