×

মুক্তচিন্তা

খাদ্যদ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি আন্তর্জাতিক কারণ কিনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২২, ০২:১৯ এএম

তেল, পেঁয়াজসহ সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। বাণিজ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ ছিল ব্যবসায়ীদের প্রতি। তারা কথা না শোনার ক্ষোভ। মজুতের অভিযোগ ছিল তেল নিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের। তেল মজুত উদ্ধার অভিযান ও জরিমানা শুরু হয় সেই সূত্রে। তেল উদ্ধার অভিযানের সংবাদ ফলাও করে প্রচারও হয়। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ, অভিমান না করেও বসে থাকেননি। সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ করেছেন। উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী যে যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। জনদুর্ভোগের কথা নয়, তারা তাদের লোকসান ও ক্ষতির কথা, সমস্যার কথা, অপমানের কথা বলেছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়ংকর ছোবল সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনকে কতটা অনিশ্চয়তার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেই সম্পর্কে টুঁ শব্দ নেই। হাতেগোনা টাকায় যাদের সংসার চলে, তারা এখন আর টাকা গুনে খাদ্যদ্রব্য ঘরে তোলেন না, তুলতে পারেন না। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধকে অনেকেই এর অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন। কেউ বলেন ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়াও এটি একটি কারণ। এমন সব যুক্তিকে কতটা মেনে নেয়া যায়, যখন দেখা যায় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক লোভে, নিজেদের হিসেবে বেপরোয়া। যা ইচ্ছা তাই করছেন তারা। তাদের মাথার ওপর তারাই, অন্য কেউ নয়। সেই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনার ভঙ্গুরতা এবং পুঁজিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার ছোট-বড় কতই না ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। যারা আন্তর্জাতিক বিষয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তাদের উদ্দেশ্যে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায় দৃষ্টান্ত হিসেবে। মাত্র কিছুদিন আগে প্রচারমাধ্যমে দেখানো হলো গ্রামে উৎপাদিত তরমুজ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে কিনে ঢাকা শহরে তা বিক্রি করা হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। এতে কৃষক কেজি দরে ১০ টাকা পেয়ে তার প্রকৃত মূল্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর কেজি দরে ৫০ টাকা চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল চক্রের পকেটে। কতটা অযৌক্তিক হবে বললে যে, বাজার অব্যবস্থাপনাই এই মধ্যস্বত্বভোগীদের পক্ষেই সবসময় কাজ করেছে এবং করছে। তাদের কপালে লাভ জুটিয়ে দিচ্ছে একটা শ্রেণি ও প্রচলিত নিয়ম-নীতি। কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্তির প্রতি কারোর দৃষ্টি না দেয়ার এই ঘটনা বলে দেয় যে, তৃণমূল পর্যায় থেকেই বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিক ও ন্যায়সঙ্গতভাবে চলছে না এবং যা সম্পূর্ণভাবে শ্রমিক-কৃষকবান্ধব তো নয়ই, বরং ব্যক্তিগোষ্ঠী স্বার্থকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে তার ঐতিহাসিক ভাষণে সুস্পষ্টভাবে কৃষক ও শ্রমিকের ন্যায্য পাওনার কথা উল্লেখ করে গেছেন এবং বাংলাদেশকে শত্রæমুক্ত করার, স্বাধীন করার এটাও ছিল অন্যতম একটি উদ্দেশ্য, লক্ষ্য। তিনি এও বলে গেছেন, তার কৃষক-শ্রমিক দুর্নীতিবাজ নন, ঘুষখোরও নন। ১৯৭১ থেকে ২০২২, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মহান নেতার কথা একচুলও অসত্য হয়নি। বরং সত্য হয়ে আছে আজো। দেশ স্বাধীন হলেও কৃষক-শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না এবং তারা দুর্নীতিবাজ বা ঘুষখোরও হননি। মূল কথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ হয়েছে, এ কথা সম্ভবত বলা যাবে না। আজো সব ন্যায্যতা ও ন্যায়সঙ্গতা সুবিধাবাদী এবং সুবিধাভোগীদের ঘরে তোলার ব্যবস্থা রয়ে গেছে। নিয়মগুলো সে রকমই এবং তারাই আরো অধিক প্রাপ্তির আশায় ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ নিঃসন্দেহে। কৃষক পান কেজি দরে ১০ টাকা আর সেটা বাজার থেকে ক্রেতা কেনেন ৬০-৭০ টাকা। মাঝের কেজি দরে ৫০ টাকা কোথায় যায়, কী হিসাবে যায় তা কে দেখছেন বিরাট প্রশ্ন রয়ে যায়। কারোর কি বলার সুযোগ আছে এখানে যে, ইউক্রেন আর রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধই কৃষককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ বলতে পারেন জ¦ালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খাতে টাকা লাগছে। কিন্তু সেটা কত টাকা, হিসাব কষে দেখেছেন কি কেউ। আবার এমন যুক্তিও তো সংশ্লিষ্টরা দিয়েছিলেন যে, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে বিধায় জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে হয়েছে। আজব সব কথাবার্তা, যুক্তি! প্রচারমাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে, পণ্যবাহী পরিবহন থেকে কীভাবে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী থেকে শুরু করে সড়কের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কমবেশি সদস্য চাঁদা সংগ্রহে জড়িত। অতিরিক্ত ৫০ টাকা কেজি দরের ঘটনায় এই চাঁদা আদায়ও একটি গল্প, নয় কী? তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শহরের বাজার কমিটি। তাদেরও চাঁদা বা কমিশন দিতে হয় বলে জানা গেছে। তরমুজের বিষয়টি একটা উদাহরণ মাত্র। দেশে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যের অস্বাভাবিক দামের পেছনে রয়েছে বাজার অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর অনিয়ম এবং প্রশাসনের অযোগ্যতা, অদক্ষতা। খাদ্য উৎপাদন ও বাজার-বণ্টন ব্যবস্থা যদি জনগণের প্রতি কল্যাণকর না হয়, জনবান্ধব না হয়, কঠোর ব্যবস্থাপনায় তা যদি পরিচালনা করা না যায় তাহলে অভাবী জনগণের আস্থা আর ভরসার জায়গা ক্রমেই দুর্বল হতে পারে। যা শুভ কিছু বয়ে আনবে না রাষ্ট্রের জন্য। পেটে সময়মতো খাবার পৌঁছাতে না পারলে উন্নয়ন শব্দটা জনগণের কাছে প্রহসনে পরিণত হয়, হবে। বিষয়টি রাজনৈতিক নয়, বরং সাধারণ কথা এবং সাধারণভাবেই ভাবতে হবে। ভাবা উচিত। একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ যখন জানতে চান, দেশটা আসলে কারা চালায়। তার জবাব আরেকজন সাধারণ মানুষই দেন, ব্যবসায়ীরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে রাজনীতিকবৃন্দ যেন ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও ব্যবসায়ী আছেন। তারা তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনায়, নীতিমালা প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন, অবদান রাখেন। তেল, পেঁয়াজ কিংবা জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধিতে কিন্তু এদের অনটন বাড়ে না। বরং সম্পদ বাড়লেও বাড়তে পারে। বাড়ছেও। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে রেশনিং সিস্টেম চালু হয়েছিল। তারপর টিসিবি। দেশে বড় বড় স্থাপনা, বড় বড় প্রকল্প, উড়াল সেতু, মেট্রোরেল, ডিজিটাল যোগাযোগ, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ই-কমার্স ইত্যাদি আধুনিক জীবনযাপনের কত শত আয়োজন, উদ্বোধন হওয়ার পরও সেই রেশনিং সিস্টেম বা টিসিবি লাইনে ফিরে যাওয়াকে পেছনে ফেরাই মনে হয় কেন জানি। অনেকে হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে, বেঁচে থাকার খাবার সহজ, সরল সামর্থ্যে না পাওয়ার কষ্টটা ভয়ংকর, যা আধুনিকতা বোঝে না, বুঝতে চায় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে স্থানীয়ভাবে পর্যালোচনা না করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফেলে বিশ্লেষণ করা কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখার অনুরোধ করব কর্তৃপক্ষকে, সরকারকে। দেশের নিজস্ব উৎপাদন, সুষম বণ্টন, ন্যায্য পাওনা-মজুরি, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও বাজার ব্যবস্থাপনা, প্রতিটি নাগরিকের জন্য আইন এক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এক তরমুজই অনেক অনিয়ম বলে দেয়। এর আগেও কৃষকের বঞ্চনার কথা উঠে এসেছে। আমরা মুখে বলছি কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ, অথচ সেই কৃষককেই আমরা বঞ্চিত করছি তার ন্যায্য পাওনা থেকে এবং সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের জীবনকে করে তুলছি দুর্বিষহ। সাধারণ মানুষ চান তার আয়ে চলতে, বেঁচে থাকতে। পরিশেষে বলব, মানবতায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। যদি বলি আমাদের দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের চেয়ে তারা আজ ভালো আছেন, কথাটা কতটা ভুল বলা হবে? স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App