×

মুক্তচিন্তা

জীবনযাত্রায় চাপ, উৎকণ্ঠায় মানুষ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২, ১২:৪৯ এএম

সময়টা ভালো যাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষের। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সেই যে কোভিডের কারণে দুই বছর আগে বাড়তে শুরু করেছিল তা আর কমছেই না, বরং কোনো কোনোটির মূল্য এখন অগ্নিমূল্যের শামিল। ভোজ্যতেল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, মূল্য দ্বিগুণে পৌঁছেছে পণ্যটির। আমাদের দেশে সাধারণত চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা, চিনি, পেঁয়াজ এ রকম কয়েকটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে সব শ্রেণির মানুষ ক্ষুব্ধ হন। দুধ, ডিম, মাংসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের গায়ে লাগে বেশি। শিশুখাদ্যের অতিরিক্ত দাম সঙ্গত কারণেই উত্তাপ ছড়ায় সব মহলে। তবে বর্তমান সময়ে সব শ্রেণির মানুষই মূল্যভারে নত। কেউই রেহাই পাচ্ছেন না অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের দায় থেকে। এবারের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট যে মূলত আন্তর্জাতিক সে বিষয়ে মানুষ কমবেশি অবহিত। করোনাকালে সারা বিশ্বে শিল্প ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন মারাত্মক বিঘিœত হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। পণ্যবাজারের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে, জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে অত্যধিক। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষেরই অবস্থা এখন বেসামাল। আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে সেটিই স্বাভাবিক। দুঃখের বিষয়, বৈশ্বিক এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের একটা অংশ নেমে গেছে কারসাজিতে, তাতে মূল্যের উল্লম্ফন ঘটছে, এমনকি যথেষ্ট সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও হাওয়া হয়ে গেছে কোনো কোনো পণ্য বাজার থেকে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে সুরক্ষা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকার বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে এটি করতে পারে। একান্ত অপরিহার্য পণ্যের ওপর ধার্যকৃত শুল্ক হ্রাস কিংবা প্রত্যাহার দ্বারা মানুষের কষ্ট লাঘব করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারের সে সামর্থ্য আছে এখন। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার করে যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়ে মানুষকে অন্তত সাময়িক সুবিধা প্রদান সম্ভব। সরকার এমন ব্যবস্থা যে আপৎকালে নেয় না তা নয়, নেয় প্রয়োজনে, তবে সময় হারিয়ে। আবার প্রদত্ত সুবিধা টার্গেট গ্রুপের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছায় না ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বাছবিচারের কারণে। বিপদ উতরে গেলে অভিজ্ঞতা সামনে থাকে না আর, ফলে ত্রæটি-বিচ্যুতির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে বারবার। সর্বশেষ খবর হলো অব্যাহত গতিতে দাম বাড়ছে সব নিত্যব্যবহার্য পণ্যের। সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট কিছুই বাদ যাচ্ছে না। বিষম সমস্যা তৈরি হয়েছে গম আমদানি নিয়ে। গমের বড় উৎস ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন। এ দুইয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমদানিকারকরা ঝুঁকেছিলেন ভারতের দিকে। ভারত তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে দিন কয়েক আগে গম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। খবরটি চাউর হতে না হতেই দেশের বাজারে তরতরিয়ে দাম বাড়া শুরু করল গমের। বস্তুত দাম বাড়ছে সবকিছুর, অথচ মানুষের আয় বাড়ছে না- এই দাঁড়িয়েছে বাস্তবতা। কোভিডের কারণে অনেকেই কর্মচ্যুত বা জীবিকা হারিয়েছিলেন, সামলে ওঠার আগেই নতুন করে গভীর সংকটে পড়লেন তারা। সীমিত আয়ের মানুষ ও পেনশনভোগীরা পড়লেন চরম বিপাকে। আমাদের কৃষি বিপদের ত্রাণকর্তা। করোনাকালেও দেশে খাদ্যের সংকট হয়নি কৃষির বদান্যতায়। কৃষির বর্ধিত উৎপাদন সম্ভবপর হচ্ছে সার সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায়। সারে সরকার বিপুল ভর্তুকি দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের সংকট দেখা দেয়ায় পরিস্থিতি ভীতিকর হয়ে উঠছে। সংকট উত্তরণে সরকারকে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। নয়তো কৃষির উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। তদারকি ছাড়া কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। বাজারের ক্ষেত্রে এটি অমোঘ সত্য। বাজার পরিস্থিতি দেখভালের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন আছে, আছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিযোগিতা কমিশনের কর্মকাণ্ড দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা, এই নামের যে সরকারি একটা দপ্তর দেশে আছে সেটিই জানে না মানুষ। কমিশন কিছু মানুষের চাকরির সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু গণমানুষের উপকার করতে পারছে বলে বোধ হয় না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর পরিস্থিতি বিরূপ হলেই কেবল মাঠে নামে, তাদের কাজের ধারাবাহিকতা নেই। এ মুহূর্তে ভোজ্যতেল নিয়ে অধিদপ্তরের অভিযান চোখে পড়ার মতো। লাখ লাখ লিটার মজুত করা তেল উদ্ধার হচ্ছে তাদের অভিযানে। শাস্তি বলতে নগদ যৎসামান্য জরিমানা। এতে আখেরে কোনো কাজ হবে না। সামান্য জরিমানা দিয়ে ছাড় পাওয়ার সুযোগ থাকায় তারা মজুতে পুনর্বার উৎসাহিত হতে দ্বিধা করবেন না। মামলা-মোকদ্দমা দ্বারা শাস্তির বিধান থাকলে অভিযান ভবিষ্যতের জন্য ফলদায়ক হতে পারত। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী আরো বেশি উদার মনের, বিশ্বাসকে ভরসা মানেন। ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা নয়ছয় করবেন না বলে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। অবশেষে তাকে বলতে হলো, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কখনো সুযোগ হাতছাড়া করেন না এটি চিরকালীন সত্য। এমন সত্যভাষণ তিনি মাথায় রাখেন না ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। আপৎকালে টিসিবি ট্রাকে করে কিছু জরুরি পণ্য শহরাঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বিক্রয় করে। এ নিয়ে হুড়োহুড়ি, বিশৃঙ্খলা ও স্বজনপ্রীতি হয়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সময়ক্ষেপণ করতে চান না অনেকে, পাওয়ারও অনিশ্চয়তা থাকে। এর পরিবর্তে স্থায়ী রেশন ব্যবস্থার প্রচলন করা যায় কিনা সরকার ভেবে দেখতে পারে। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে বছরজুড়ে অব্যাহত থাকবে এই রেশন প্রদান কর্মসূচি। স্বাধীনতার আগে এবং পরে কিছুকাল আমাদের দেশে এমন রেশন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। পাশের দেশ ভারতে এ ব্যবস্থা চালু আছে। এ রকম স্থায়ী রেশন ব্যবস্থা আবার চালু করা গেলে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ বিশেষ উপকৃত হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ নিয়ে চাপে পড়া মানুষ উৎকণ্ঠায় আছে অন্য কারণেও। কোনো বিশ্লেষণ ছাড়াই ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এমন বার্তা যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার মতো হবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃবর্গ এ ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ থাকায় প্রচার ব্যাপকতা পাচ্ছে। যুক্তি হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পকে। শ্রীলঙ্কা তাদের তিনটি মেগা প্রকল্প- একটি বিমানবন্দর, একটি সমুদ্রবন্দর ও একটি পোর্ট সিটি গড়তে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। আমাদেরও অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান; যেমন- পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, রামু-কক্সবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ধস শুধু ওই তিন মেগা প্রকল্পের কারণে নামেনি, আরো অনেক বড় বড় কারণ আছে। করোনা মহামারির কারণে তাদের পর্যটন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে বিপর্যয় ঘটেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমনই সঙ্গিন পর্যায়ে যে বাংলাদেশ থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা ধার নিতে হয়েছে। রাসায়নিক সার প্রয়োগ আচমকা বন্ধ করতে গিয়ে তারা কৃষি উৎপাদন মারাত্মক কমিয়ে ফেলেছে। মূল্য সংযোজন কর প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনায় রাষ্ট্রের আয় কমেছে। আমাদের দেশে এমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। মেগা প্রকল্পগুলো শ্রীলঙ্কার মতো আয়হীন না হয়ে আয়বর্ধক হবে ধরে নেয়া যায়। তবে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারকে প্রতিপদে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি মজবুত অবস্থানে থাকার কথা এতদিন দেশের মানুষ শুনে এসেছে। সম্প্রতি সেখানে সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান দুই উৎসের একটি পোশাক শিল্পের রপ্তানি, এ খাতে আয় বাড়ছে। অপর উৎস প্রবাসী আয়, যা কমছে। পরিস্থিতির চাপে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নতুন করে বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের মতো। অর্থনীতিবিদ কারো কারো মতে এই হার ৬ শতাংশের অধিক। মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত। সরকারের নীতিসহায়তা পর্যাপ্ত না হলে জীবনযাত্রা আরো বিপর্যস্ত হবে, সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনী না বাড়ালে সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছাবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারকে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে।

 : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App