×

মুক্তচিন্তা

কবে এ দূষিত সমাজ ধর্ষণমুক্ত হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২, ১২:৫০ এএম

সিলেটে স্বনামখ্যাত এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে তরুণী গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গোটা সিলেট শহর মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কারণটা কি তাদের গর্বের এমসি কলেজের চারিত্র দূষণ। দূষণ কলেজের নয়, কলেজের কিছুসংখ্যক ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তের। এ ঘটনা দেশময় উত্তেজনা সৃষ্টি করে যথারীতি শাহবাগসহ। স্বভাবতই প্রধানমন্ত্রী ধর্ষিতার পাশে এসে দাঁড়ান, যেমন দাঁড়ান ফেনী মাদ্রাসাছাত্রীর পাশে, ‘যে কারণে অপবাদের তদন্ত ও বিচার’ যথারীতি, যথাসময়ে সম্পন্ন হয় এবং ধর্ষণের বিচার চরম শাস্তি স্বীকৃতি পায়- মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো সন্তুষ্টই। ধর্ষণ ও হত্যার চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড- এই আইন অপরাধী মহলে কিছুটা ভীতির সঞ্চার করে এবং ধর্ষণের সংখ্যা পরবর্তী কয়েক মাসে কমে আসে। কিন্তু একটিও চরম শাস্তি কার্যকর হতে না দেখে অপরাধী মহল পূর্ব সাহস পায় অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে। সংবাদপত্রগুলোতে আবার ধর্ষণই নয়, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের খবর প্রকাশ পেতে থাকে। যেমন- সংবাদ শিরোনাম : ‘সৌদি প্রবাসীর স্ত্রীর ছয় টুকরো লাশ উদ্ধার’ (কালের কণ্ঠ, ১৮.০২.২২)। আরেকটি গুরুতর খবর শিরোনাম : ‘স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ।’ (প্রথম আলো, ২০.০৩.২২)। এবার ঘটনাস্থল খুলনা। রাজধানী থেকে দূর দক্ষিণাঞ্চলও বাদ নেই। এ রকম কয়েকটি প্রকাশিত খবর থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারা যায় যে, ইতোপূর্বেকার ধর্ষণের ঘটনাবলির প্রকাশ্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পরবর্তী ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনাবলি নাও ঘটতে পারত। আমাদের বিশ্বাস, একমাত্র কঠোর শাস্তিই নারী ও শিশুকন্যার ওপর সংঘটিত বর্বরতা বন্ধ করতে পারে। এর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। আর যেটা আছে তা হলো, সামাজিক প্রতিরোধক শক্তির বিকাশ ঘটানো। সেটা তো দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া তথা সমাজ বদল। সেটা সহজসাধ্য নয়। সেটার আরেক নাম বিপ্লব। সেটা দীর্ঘ সাধনা ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। কেউ তর্কছলে বলতে পারেন সমাজ বিপ্লব সহজসাধ্য নয়। তুলনায় সমাজ সংস্কার সহজতর। কিন্তু সেখানেও দরকার সংঘবদ্ধ সাংগঠনিক প্রয়াস এবং সর্বস্তরে সদিচ্ছার প্রকাশ ও আন্তরিক প্রয়াস। সরকার থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে সাংগঠনিক তৎপরতা। কিন্তু তেমন সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি কি বাংলাদেশে বিরাজ করছে? অবস্থাদৃষ্টে অন্তত আমার তো তেমনটা মনে হয় না। সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা- কী রাজনৈতিক, কী অরাজনৈতিক নেতৃস্থানীয়, বিত্তবান ব্যক্তিরা নিজ নিজ স্বার্থে, সমৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধির কাজে ব্যস্ত, সেখানে কোথায় কোন নারী ধর্ষিত হলো তাতে কান দেয়ার সময় তাদের নেই। সমাজসেবা ব্রত নয়, আত্ম-উন্নয়নই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি তাদের পেশাগত জীবনের অবিশ্বাস্য অবস্থায় দিনরাত্রি একাকার করে ফেলছেন। সমৃদ্ধির ও খ্যাতি প্রতিষ্ঠার মগডালে চড়াই তাদের জীবনে একমাত্র সত্য ও লক্ষ্য। তাই তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। আশ্চর্য প্রগতিবাদী রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দল-সংগঠনগুলো নারী নির্যাতনকে ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করতে বড় আগ্রহী নয়, অথচ তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা ভিন্ন কথা বলে। অথচ সে ভিন্ন কথার দায়িত্ব পালনে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। তাই সংবাদপত্রের ভয়ংকর সব নারী-শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা নিয়ে আন্দোলনের কথা তাদের চেতনায় সাড়া জাগায় না, আন্দোলনের কথা ভাবায় না। ব্যতিক্রর্মীরা শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠান করে দায়িত্ব সমাপন করেন, এর চেয়ে বড় কিছু ভাবেন না। যারা ভাবেন তাদের তেমন কিছু করার সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই। অথচ দৈনিক পত্রিকায় এ সম্পর্কে খবরের অভাব নেই- যেমন ‘কলেজছাত্রীকে ৫ দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ’। ভাবা যায় কোনো সভ্য দেশে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি? কিন্তু আমাদের দেশে তা ঘটছে, বলা যায় প্রায়ই ঘটে থাকে। এ দেশে ধর্ষণের ইতিহাস তাই বলে। তা সত্ত্বেও শাসনব্যবস্থা চরম প্রতিকারের কথা ভাবে না। কিছুদিন আগে সংঘটিত সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে চরম শাস্তির বিধান করা হয়; কিন্তু এর প্রয়োগ দেখা যায়নি। তাই বর্তমানে সব ঘটনা- ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর জানাজানির ভয়ে খুন’ (কালের কণ্ঠ, ২০.০২.২২)। কী বীভৎস ঘটনা। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদ শিরোনাম : ‘তিন দিনে ধর্ষণের শিকার তিন শিশু’ (কালের কণ্ঠ, ২৩.০৩.২২)। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম- শিক্ষার্থী ধর্ষণ : বখাটে বেপরোয়া (সমকাল, ২৭.০২.২২)। বেপরোয়া বখাটেদের ধর্ষণকাজ বন্ধ করার ক্ষমতা কি নিরাপত্তা-প্রশাসনের নেই? তাই কালের কণ্ঠ সম্পাদকীয় শিরোনাম ব্যবস্থা সম্পর্কে : (দ্রুত বিচার হতে হবে, ২৬.০২.২২)। ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সমকালের এক উপ-সম্পাদকীয়র শিরোনাম : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা যে বার্তা দেয় (২৬.০২.২২)’। এতে ঘটনাবলির উল্লেখ করে বিচারহীনতা বা দীর্ঘসূত্রতার উল্লেখ করে বলা হয়েছে- এ বিষয়ে দ্রুত গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথমেই যে ধর্ষণ সংখ্যা বৃদ্ধি আগামী বছরে তা আরো বাড়বে। তাই দ্রুত বিচার (৬ মাসের মধ্যে) ব্যবস্থায় আইন ও আদালতের প্রয়োজন। আরো বলা হয়েছে ধর্ষণের কঠোর শাস্তির কথা। গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এসব ঘটনার বিচারে বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠার ওপর। এ প্রসঙ্গে সচেতন সামাজিক শক্তির প্রকাশ এবং প্রতিরোধ উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আমার লেখায় বিশদ আলোচনায় প্রতিকার ব্যবস্থার কথা বারবার বলা হয়েছে, বিশেষ করে চরম শাস্তি ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে। আলোচ্য লেখায়ও এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

দুই. এই বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম : ‘মা-মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়নি কেউ’ (ভোরের কাগজ, ৩০.০৩.২২)। অকুস্থল সিরাজগঞ্জ। ভোরের কাগজের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সারাদেশে ১ হাজার ১১৭ জন কন্যা-শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ধর্ষণ যেমন একক, তেমন সংঘবদ্ধ। অন্য এক খবরে প্রকাশ ‘অপরাধ দমনে তৎপর পুলিশ। নোয়াখালীতে ২৬ মাসে ২২৮ জন ধর্ষণ, বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন (২৮.০৩.২২)।’ বোঝা যাচ্ছে কী মাত্রায় বেপরোয়া দুর্বৃত্ত ধর্ষককুল। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কী এর কারণ। ইতোপূর্বে এ বিষয়ে সংবাদপত্রগুলোতে খবর, মন্তব্য, সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বহু বিশিষ্টজনের লেখায় অন্যতম কারণ হিসেবে বিচারহীনতা বা বিলম্বিত বিচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিচার ও শাস্তির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আমরা সেই সঙ্গে আরো একটি কথা যোগ করি। তা হলো, শুধু শাস্তির রায়ই যথেষ্ট নয়, দরকার এর দ্রুত প্রয়োগ, ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর, যা দেখে ধর্ষককুল ভয় পাবে, ধর্ষণের দুর্বৃত্তপনায় দুইবার চিন্তা করবে। এসব ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে। আর সমাজটা এতই দূষিত যে শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণে ইতস্তত করে না, তার বিবেকে বাধে না। জনপ্রতিনিধি এ ব্যাপারে উদাসীনই নন, প্রায়ই প্রতাপশালী ধর্ষকের পক্ষে। এমন একাধিক ঘটনা দৈনিকে প্রকাশিত হয় মাঝে মাঝে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি শিরোনাম (২৮.০৩.২২) : ‘ধর্ষণ চেষ্টা মামলা থাকার পরও চেয়ারম্যানের বাড়িতে সালিশ’। অকুস্থল কুলিয়ারচর। শুধু ঢাকা বা বড় বড় শহরই নয়, এ সামাজিক দূষণের বহুমুখী রূপ ছড়িয়ে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। এর সঙ্গে জড়িত একাধিক শক্তি। আর ধর্ষক ও শ্রেণি নির্বিশেষ- শিক্ষিত-অশিক্ষিতে কোনো ভেদ নেই। প্রশ্ন : আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি, যেখানে শিক্ষার আলোও আমাদের মননকে আলোকিত করে না। এ দূষিত সমাজের পরিবর্তন ঘটানো অবস্থাদৃষ্টে অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আমাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন এদিক থেকে কবে সচেতন হবে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App