×

মুক্তচিন্তা

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : জাতির মর্যাদার সম্বল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২, ১২:৪৮ এএম

যে সংস্কৃতির উত্থান ঘটেছে সবুজ প্রান্তরের নদীসিক্ত ভূমি থেকে। যে সংস্কৃতিকে লালন করছে মৌসুমি আকাশের রোদ, বৃষ্টি আর ঝড় প্রাচুর্যের প্রখর ব্যভিচার, যন্ত্র-সভ্যতার অস্থিরতা যে সংস্কৃতিকে বিকৃত করতে পারেনি। সংগীত, সাহিত্য, ভাষা কামানের গোলা, আমেরিকার সপ্তম নৌবহরকেও তুচ্ছ করে দিতে পারে। আমার মা, আমার ভাষা, আমার চেতনাকে এমনভাবে জাগাতে পারে যখন আমার পক্ষে সত্যিই বলা সম্ভব জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারির চেতনা আমাদের স্পর্শ করুক। কলেজের গণ্ডি পেরুবার আগে, ১৯৫২ সালের রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারির অভিঘাতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি লিখেছিলেন কালজয়ী কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এরপর ইতিহাস হয়ে যায় সেই কবিতা। প্রথমে আবদুল লতিফের সুরে তা গানে রূপ নেয়। পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে তা হয়ে ওঠে অবিনাশী ভাষার গান। জীবদ্দশাতেই তাকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় তার গান বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে তার লেখনি বিশেষ করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এক অমর সৃষ্টি। বহু তরুণের হৃদয়ে বিপ্লবের ঝড় তুলেছিল। এখন বিশ্বনন্দিত। বাঙালির কাছে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রভাতফেরির ‘সিগনেচার টিউন’ হয়ে রয়েছে ওই গানটি। সেই শোকসংগীত আমাদের নানা সংকটে, নানা দুর্যোগে, দুর্বিপাকে রুখে দাঁড়ানোর অনির্বাণ প্রেরণা জোগায়। এটি খুবই বিস্ময়কর যে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি গান রচনা করেছেন। সেই গান পুরো বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব করে যুগ যুগ ধরে। বাঙালির প্রতিবাদী চরিত্র, রক্ত দেয়ার মানসিকতাকে এই গান প্রতিনিধিত্ব করে। এই গান সারাবিশ্বের ৩৫ কোটি বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল অনুরণিত হবে। আজ থেকে ১০০/২০০ বছর পরও আমেরিকা থেকে চীন বিশ্বের ১৯৫টি দেশে পর্যন্ত প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ গান গীত হবে। পৃথিবীতে যত দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে, একুশের চেতনায় অমর একুশে গানের রচয়িতা গাফ্ফার চৌধুরী চিরভাস্বর হয়েই থাকবেন। কিন্তু তার মৃত্যু আমাদের শোকস্তব্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন তার প্রকাশিত পত্রিকা ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। শুধু সংবাদ জগতেই নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আবদুল গাফ্ফারের প্রচুর অবদান রয়েছে। ১৯৬৩ সালে তিনি ইউনেস্কো পুরস্কার পান। স্বাধীনতা পদক ২০০৯-সহ একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি একাধিক গল্প, উপন্যাস লিখেছিলেন। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটকও রচনা করেছেন তিনি। জীবনের ওপারে গিয়েও তিনি চিরকাল ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবেন। পৃথিবীতে যত দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে, একুশের চেতনায় অমর একুশে গানের রচয়িতা গাফ্ফার চৌধুরী চিরভাস্বর হয়েই থাকবেন। তার কর্ম ও লেখনি তরুণ লেখকদের জন্য চির প্রেরণার হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, এই গানটিও ততদিন থাকবে। স্রষ্টামাত্রেরই সংশয়, সৃষ্টি বাঁচবে তো! নশ্বর জীবদেহ বিলীন হয়ে যাবে। মুছে যাবে বেঁচে থাকার যাবতীয় বাহ্য অহঙ্কার। সাধারণ মানুষের এই পরিণতি। এ নিয়ে কারোর অভিযোগও থাকে না কিছু, কিন্তু সৃজনশীল মানুষের ভিন্নতর এক অন্বেষণ থাকে। থাকে অমরত্বের আত্মগত এক স্পৃহা। আমি বা নামরূপের লয় হোক, ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার সৃষ্টি যেন নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। মহাকালের অমোঘ সম্মার্জনী সব কিছুই নিঃশেষে না বিদায় করে দেয় অনন্ত মানবস্মৃতিতে যেন চিরলগ্ন থাকতে পারি। রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মহান স্রষ্টারও সংশয় ছিল, আজি হতে শতবর্ষ পরে, কোন সে-পাঠক, যিনি তন্ময় হয়ে থাকবেন কবির সৃষ্টিতে! শতাব্দীর অতিক্রান্ত প্রান্তে তিনি কি স্মৃত হবেন। কবি-প্রার্থনা নিজেরই সৃষ্টির কাছে, তবু মনে রেখো। যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে- তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে, কিন্তু আমার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক বিস্ময়ে যেন এই উক্তি হয় তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী! ক্ষণকাল থেকে চিরকালে উত্তরণের গুণ যেন আমার থাকে। এই আমার সাধনা। বিচারক আমি নই। বিচারক সেই মহাকাল। যতকাল জাতি হিসেবে বাঙালি টিকে থাকবে, ততকাল গীত হবে তার লেখা- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। কিন্তু অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে তরুণ বেলার একটি কাজের জন্যই বাঙালি আর বাংলাদেশের সঙ্গে অনন্তকাল জড়িয়ে থাকবেন তিনি। তা হলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র গানটি রচনা। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, এই গানটিও ততদিন থাকবে। লেখক এবং অন্যান্য লোকপ্রিয় নায়কদের পরিপূর্ণ রূপে জানবার ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবার উদ্দেশ্যেই আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সংরক্ষণের রীতি প্রচলিত হয়েছে। কালজয়ী গানের কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচিহ্নটি যাতে এক কৃতজ্ঞ জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের উপযুক্ত প্রতীকরূপে পরিগণিত, কামনা করি।

সাইদ আহমেদ বাবু : সভাপতি, আমরা ক’জন মুজিব সেনা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App