×

মুক্তচিন্তা

বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বদল, শঠতার কৌশল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ মে ২০২২, ০১:০০ এএম

ভারতের বর্তমান রাজনীতিতে বিজেপি চমক সৃষ্টিতে অনন্যই বলা যাবে। একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশবাসীকে হতবিহ্বল করে এসেছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে নাগরিকত্ব আইনসহ নানা হঠকারী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে। বিশেষ করে দ্বিতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের পর ধরাকে সরা-জ্ঞান মনে করে মর্জিমাফিক স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণের নানা ফন্দি এঁটে চলেছে। তারপরও ভারতীয় জনগণ কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদেই পূর্ণ আস্থা রেখেছে। সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে নির্বাচনে ভোট দিয়ে জয়ী করে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যগুলোর বিধানসভার নির্বাচনগুলোতে তার প্রমাণ মেলে। কৃষক আন্দোলনের পর ভারতের সর্ববৃহৎ প্রদেশ উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়ে বিজ্ঞজনেরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছিলেন বটে; কিন্তু বিজেপির জয়যাত্রা রদ হয়নি অব্যাহত গতিতে এগিয়েছে। উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে তারা জয়ী হয়েছে। ওই যে বলেছি ভারতীয় জনগণ হিন্দু জাতীয়তাবাদে চরম আস্থা রেখে বিজেপিকে ভোট দিয়ে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী করে চলেছে। সব রাজ্যের ক্ষেত্রে বিজেপির জয়যাত্রা একই গতিতে অবশ্য চলছে না। সেখানে তারা নানা উপায়ে ক্ষমতা হাতাতে নানা কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে। আর যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় জনপ্রিয়তা হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেখানে তারা মুখ্যমন্ত্রী বদলের অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করে এসেছে। ২০১৮ সালের ত্রিপুরা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সম্পূর্ণ শূন্য অবস্থান থেকে বিজেপি রাজ্য-ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। ত্রিপুরার কংগ্রেস দলীয় নেতাদের দলে ভিড়িয়ে কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক হাতিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। ওই রাজ্যে বিজেপির একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সিপিআইএম বা বামফ্রন্ট। গত চার বছরের অধিক কাল ধরে ত্রিপুরায় সহিংস-সন্ত্রাসী জংলী শাসন চালিয়ে এসেছে। ২০১৮-এর বিধানসভার নির্বাচনের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ত্রিপুরার জনগণকে হেন কোনো প্রতিশ্রæতি নেই, যা প্রদানে সামান্য কৃপণতা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অগণিত প্রতিশ্রæতির প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ত্রিপুরার জনগণ রাজ্যে নবাগত সাম্প্রদায়িক দলটিকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু দ্রুতই তাদের মোহভঙ্গ ঘটে। শত-সহস্র প্রতিশ্রæতির এযাবৎ একটিও পালন করেনি রাজ্য সরকার। বিপরীতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি তো করেইনি বরং রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গণছাঁটাই করে হাজার হাজার মানুষকে বেকারে পরিণত করেছে। রাজ্যজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের শারীরিক নির্যাতনসহ গৃহছাড়া, এলাকাছাড়া করে বিরোধী দলের সব কর্মসূচি বানচালে রাজ্যের পুলিশ এবং বিজেপির সন্ত্রাসী বাইকবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হিংসার রাজনীতি প্রয়োগ করেছে। বিজেপির কর্মী, বাইকবাহিনীতে যারা রয়েছে তারা প্রায় সবাই সাবেক কংগ্রেস দলীয় সদস্য। অর্থাৎ বামফ্রন্টকে নির্মূলে কংগ্রেস বিজেপির পতাকাতলে শামিল হয়ে বামদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত চালিয়ে এসেছে। তাই গত ২০১৮ সালে বিজেপির ক্ষমতা লাভের পর ত্রিপুরার গণতন্ত্র, দেশটির সংবিধান, আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক কার্যক্রম সবই ভূলুণ্ঠিত করে ফ্যাসিবাদী শাসন অব্যাহত গতিতে জারি রয়েছে। রাজ্যের সিপিএম নেতাকর্মীরা যেমন রাজ্যের পুলিশ এবং বিজেপির সন্ত্রাসীদের দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের অগণিত কার্যালয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আগরতলার মেলার মাঠস্থ সিপিএমের রাজ্য-অফিস পর্যন্ত অক্ষত রাখেনি, আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের নেতৃত্বাধীন সরকারের এসব অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী অপতৎপরতায় রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকেছে। আগামী ২০২৩ সালের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার মুখে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব ব্যর্থতার বলির পাঁঠা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবকে পদত্যাগে বাধ্য করে হৃত জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে। বিজেপির শাসনামলে সুদীর্ঘকালের ত্রিপুরার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। চরম ফ্যাসিবাদী এবং জনবিরোধী নানা পদক্ষেপে মানুষ বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটা আঁচ করেই তুরুপের তাস হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বদল করে দলীয় দায় বিপ্লব দেবের কাঁধে তুলে দিয়ে তাকে বিদায় করে দলের ভাবমূর্তি ফেরানোর কৌশল নিয়েছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব পদত্যাগ করেছেন। তার স্থলে নতুন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বিজেপির ত্রিপুরা রাজ্য সভাপতি মানিক সাহা। মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার পরপরই চিহ্নিত সন্ত্রাসী, হত্যা মামলার ফেরারী আসামিদের নতুন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে অভিনন্দিত করার সংবাদ ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মানিক সাহা বিধায়ক নন। দলীয় সাংসদ দ্বারা রাজ্যসভার সদস্য। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। আগামী বিধানসভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয়েছে। বিজেপি অজস্র প্রতারণার মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দিয়ে জনগণের রায় পক্ষে টেনেছিল। কিন্তু একটি প্রতিশ্রæতিও গত সাড়ে ৪ বছরে পূরণ করেনি। পাশাপাশি অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনে ত্রিপুরাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারেই মুখ্যমন্ত্রী বদল করে পরিস্থিতি পক্ষে নেয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে। গত ১৪ মে রাজ্যপালের কাছে বিপ্লব দেব পদত্যাগ পত্র জমা দেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘দল সবার উপরে। আমি বিজেপির অনুগত কর্মী। আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, আমি তা সাধ্যানুযায়ী পালনের চেষ্টা করেছি। রাজ্যের উন্নয়ন এবং মানুষের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করাই ছিল আমার লক্ষ্য। রাজ্যে দলের ভিত শক্ত করার জন্য আমি এখন তৃণমূল স্তরেও কাজ করতে তৈরি। আমি এখন আর মুখ্যমন্ত্রী নই। আমি দলের সাধারণ কর্মী।’ প্রসঙ্গত, গত ১২ মে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব কেন্দ্রের ডাকে সাড়া দিয়ে দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ত্রিপুরা রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে শাসক দলের মধ্যে তীব্র গোষ্ঠীদ্ব›দ্ব প্রকাশ্যে আসার পরিপ্রেক্ষিতে এবং রাজ্য সরকারের ইমেজ সংকটে বিপ্লব দেবকে তলব করে দুই কেন্দ্রীয় নেতার সিদ্ধান্তক্রমে বিপ্লব দেব পদত্যাগে বাধ্য হন। বিপ্লব দেবের নেতৃত্বে ত্রিপুরার রাজ্য সরকারের চরম ফ্যাসিবাদী শাসনে জনজীবনে তীব্র ক্ষোভ ক্রমেই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি বলে বাস্তবে অবশিষ্ট কিছুই নেই। আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পতন অনিবার্য ভেবেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মানুষের আস্থা ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রী বদলের কৌশল বেছে নিয়েছে। চেষ্টা চালাচ্ছে দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে। জানা যায় নতুন মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্য সভাপতির পদটি বিপ্লব দেবকে সান্ত¡নাস্বরূপ দেয়া হবে। রাজ্যের বর্তমান উপ-মুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববার্মাও মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিলেন। কিন্তু তার ভাগ্যে পদটি জোটেনি। এ নিয়ে বিজেপির রাজ্য দপ্তরে চেয়ার মারামারি, হাতাহাতি, বচসা পর্যন্ত হয়েছে। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বদলে দলের ভাবমূর্তি ফেরানোর কৌশল এটাই প্রথম নয়। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বিধানসভার নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাট রাজ্যে অপসারিত হন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি। উত্তরাখণ্ডে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন তিরথ সিং রাওয়াত, তাকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াতকে। কিছুদিন পর তিরথ সিং রাওয়াতকে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয়। আবার শেষ মুহূর্তে তিরথ সিং রাওয়াতকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় পুস্কর সিং দামিকে। একই প্রক্রিয়ায় কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় এস আর বুম্মাইকে। তিনি এখন ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির এই মুখ্যমন্ত্রী বদলের ফলে তারা যে লাভবান হয়নি তা ঠিক নয়। লাভবান হওয়ার ফলে একই কৌশল বারবার প্রয়োগ করে চলেছে। তবে ত্রিপুরার ক্ষেত্রে এই কৌশল কাজে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা নির্দলীয় ভোটাররা বিজেপির প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া অজস্র প্রতিশ্রæতির একটিও যেখানে বাস্তবায়িত হয়নি, সেখানে আর তারা বিজেপির প্রতি আস্থা রাখে কীভাবে! তাই আগাম বলা যায় ২০২৩ সালের ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে কারচুপিবিহীন, ছাপ্পাভোট বিহীন, বুথদখল বিহীন এবং সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করে তবে বিজেপির পরাজয় ঠেকানোর কোনোই উপায় থাকবে না। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা ইতোমধ্যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান প্রায় বিজেপি দলের পক্ষে নির্লজ্জ ভূমিকা রেখে বিজেপির জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এর ব্যত্যয় ঘটা কঠিন হলেও অসম্ভব নিশ্চয় নয়। জনপ্রতিরোধেই নির্বাচনী ব্যবস্থা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলেই ভরসা করা যায়। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App