×

মুক্তচিন্তা

কার টাকায় পদ্মা সেতু

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ মে ২০২২, ০১:০০ এএম

যখন দেশের ১৭ কোটি মানুষ স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিক আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন তখন কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন বিএনপির প্রথম সারির নেতা- পদ্মা সেতু কার টাকার! তার এ প্রশ্ন তোলার কারণ সম্ভবত গত ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য। সেদিন এক সভায় শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। অন্যান্য বিষয়ের মতো পদ্মা সেতু উদ্বোধন বিষয়েও অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। এই অনুভূতি প্রকাশের সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাসটি তার মানসপটে ভেসে উঠেছিল- ভেসে উঠেছিল সে সময়ে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডও। এসব ব্যক্তির তৎকালীন রূঢ় আচরণের কারণে শেখ হাসিনা আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। শেখ হাসিনার সেসব মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া বিএনপির বিভিন্ন সারির নেতাসহ অনেকে অনেকভাবেই ব্যক্ত করছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা ব্যক্তিগত বিবেচনায় না দেখে সামষ্টিকভাবেই দেখতে চাই। তাহলেই সবকিছু সহজ হয়। এই মন্তব্যকে আক্ষরিক-অর্থে নেয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না। কারণ পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনাকালে এবং প্রকল্প প্রণীত হলে ‘কথিত দুর্নীতি’ যেভাবে চাওর হতে থাকে তার ‘পালে হাওয়া’ দেয় অনেকেই! যারা দেশে-বিদেশে বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছেন সামষ্টিকভাবে তারাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্দিষ্টজন। প্রধানমন্ত্রী না বললেও পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়নে বিরোধী সব পক্ষের এক প্রকার ‘নাকানো-চুবানো’ খাওয়া হয়েই গেছে- সাধারণের কাছে সত্যিই তারা ‘নাকানো-চুবানো’ খেয়েছেন! এদেরকে অনন্তকাল ‘নাকানো-চুবানো’ হজমই করতে হবে- এটাই তাদের অদৃষ্ট! শেখ হাসিনার মন্তব্যের পেছনকার ইতিহাস কী কম তিক্ততায় ভরা, কম অপমানে অপদস্ত, কম গøানিতে বিপর্যস্ত! দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের এমনকি বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের সঙ্গে বিদেশিদের পরিচয়-পর্বের প্রথম অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতি নিয়েই। তখন আমাদের মুখখানা সহজেই কালো হয়ে যেত! অপমান, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা ছিল সর্বত্র! বিশ্বব্যাপী আমাদের হেয়প্রতিপন্ন করেছেন দেশের কিছু রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের বিবেকসম্পন্নরা! তারা আমাদের হেয়প্রতিপন্ন করেই ক্ষান্ত হননি- পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রতিশ্রæত অর্থ বরাদ্দ না দিতেও নানা রকমের সালিশ-নালিশ, দেন-দরবারে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালীদের সহায়তা নিয়েছেন। সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নিজস্ব অর্থায়নে যিনি পদ্মা সেতু নির্মাণে সফল হয়েছেন বিরোধিতাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের সমালোচনা করবেনই। সমালোচনার বক্তব্য ও ভাষা একান্তই তার। বিএনপির বুঝতে হবে শেখ হাসিনার ‘কথার কথা’র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা না-করায় দেশবাসীর কিছু যায়-আসে না। শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন- এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। সবাই জানেন পদ্মা সেতু দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় নির্মিত। সুতরাং তারা এসব প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে জনগণকে আবারো যে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন তাও স্পষ্ট। পদ্মা সেতু নিয়ে বড় বড় কথা বলা একজনের পক্ষেই মানায়- তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। জনগণের টাকা বিএনপির শাসনামলেও ছিল। সে টাকার পরিমাণও ছিল অঢেল! কিন্তু সাধারণের সেই টাকা তারেক-কোকো গং কীভাবে পাচার করেছেন তাও দেশবাসী দেখেছেন। শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে শেখ হাসিনা যখন উদ্যমী হয়েছেন তখন বিএনপি ও তার সহযোগীরা অপতৎপরতায় দেশ-বিদেশে কীভাবে সক্রিয় ছিল দেশের মানুষ তাও কম-বেশি দেখেছেন! আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তবে দেখতে পাব এই সেতু নির্মাণকালীন কত গাল-গল্প, কত কিস্সা-কাহিনী! দুর্নীতির কল্পিত আখ্যানের লাগামহীন বয়ানে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল দেশ! সবার মুখে মুখে ছিল ‘কল্পিত দুর্নীতি’র কাহিনী। গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বোঝা যাবে এর মূল কারণ ছিল একটিই- আওয়ামী লীগকে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাফল্য থেকে বঞ্চিত করা। তাই অনেকেই ‘আদা-জল’ খেয়ে লেগে পড়েছিলেন! বিএনপি চেয়ারপারসনও পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপে মশগুল হয়েছিলেন! তারা বিদেশেও নানা রকমের দূতিয়াল নিয়োগ করেছিলেন, নিয়োগ করেছিলেন আন্তর্জাতিক ‘লবিং’ প্রতিষ্ঠানও। যাতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রতিশ্রæত অর্থ প্রদান না করে। পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই ‘কল্পিত দুর্নীতির আখ্যান’ নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বহুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা এবং সুশীল সমাজের দায়িত্বশীলরাও তীর্যক ও কটূ মন্তব্যে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। পদ্মা সেতুর আসন্ন উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখে পুরনো সেসব তিক্ত ও শ্লেষাত্মক মন্তব্য এখন আমাদের স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে- ভেসে ওঠে ভিন্ন তাৎপর্যে। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ দিকনির্দেশনা ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে তখন সেসব ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়েছে বলেই আজ আমরা স্বপ্ন বাস্তবায়নের অমিত স্পর্ধায় তাদের সেসব মন্তব্যের প্রতি নির্দ্বিধায় করুণার দৃষ্টিটুকুই নিক্ষেপ করতে পারি মাত্র! ইতিহাস কত নির্মম তাও আমরা অনেকটা বাস্তবসম্মতভাবে উপলব্ধি করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক যে ‘ট্রল’ হয়েছে আজো তা ঘুরে ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই আসছে- কিন্তু এবার উপস্থাপনায় বৈপরীত্য! সেসব কনটেন্টের ধারাভাষ্যও ‘বোল-পাল্টানো’! সে সময়ের ‘জনপ্রিয় বচন’ আজ ‘আঁস্তাকুড়ের প্যাঁচাল’ হিসেবে সাধারণ মানুষ রঙ্গ-তামসায় তা উপভোগও করছেন। সেসব কয়েকটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে বিএনপি নেতাদের আচরণ স্পষ্ট হবে। বিএনপির মহাসচিব বলেছিলেন : ‘দেশে পদ্মা সেতুর দরকার নেই। তারা (আওয়ামী লীগ) পদ্মা সেতু তৈরি করে, কর্ণফুলী টানেল তৈরি করে, যেটা সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয়।’ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের যে বিপুল অগ্রগতি সম্ভব সে বিষয়ে একটি দলের মহাসচিবের ধারণা থাকবে না তা আমরা মনে করি না। কিন্তু এরূপ বক্তব্যের মাধ্যমে দলীয় মহাসচিব জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে অসম্মান করেছিলেন। প্রতারণা করেছিলেন পদ্মা সেতুর সঙ্গে যাদের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং উন্নতি জড়িত তাদের সঙ্গে! ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন : ‘সেতু নির্মাণ করা তাদের লক্ষ্য ছিল না। এই সরকারের ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঘুষ নেয়া ছিল মূল লক্ষ্য।’ তিনি আজ বেঁচে থাকলে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী নিয়ে কী বলতেন তা আমরা জানি না। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল করেন না এমন অনেকে বিএনপির বক্তব্যকেই সমর্থন করেছেন- বিএনপির পক্ষই অবলম্বন করেছেন! সুশীল সমাজের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যাতে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন না ঘটে সেই চেষ্টাও করেছেন! ‘সুজন’ সম্পাদক বলেছিলেন : ‘দুর্নীতি আমাদের কীভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে তার আরেকটি উদাহরণ এটি (পদ্মা সেতু)। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।’ অথচ পদ্মা সেতু চালু হলে উন্নয়নে ব্যাপক গতির সঞ্চার ঘটবে বলে দেশি-বিদেশি অনেক অর্থনীতিবিদ মতামত দিয়েছেন। জাতীয় উন্নয়নের পাশাপাশি পদ্মা সেতু আন্তর্জাতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলেও তারা বলেছিলেন। ‘সুজন’ সম্পাদকরা কেন এরূপ মন্তব্য করেছিলেন জাতির কাছে ক্রমে তা স্পষ্ট হয়েছে। টিআইবির নির্বাহী প্রধান আরো এক ধাপ এগিয়ে সরকার এবং দুদকের ভূমিকা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন : ‘এই ঘটনা (পদ্মা সেতু দুর্নীতি) নিয়ে তদন্ত করার সামর্থ্য আছে কিনা দুদকের, সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা তাদের আছে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’ অথচ কেবল দুদক নয়- আন্তর্জাতিক আদালতের তদন্তেও পদ্মা সেতু প্রকল্পে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের এক সময়ের হাততালি পাওয়া বক্তব্য-ভাষণ আজ মনোমালিন্যে কেবল আমাদের করুণাদৃষ্টিই লাভ করে মাত্র! হিংসা-দ্বেষ এবং বিবেকবর্জিত অপরিণামদর্শিতার ফলাফল এমনই হয়! সে সময় এক সভায় তিনি বলেছিলেন : ‘এখন পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে (আওয়ামী লীগ)। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। সেই সেতুতে ওঠা… যদি জোড়াতালি দিয়ে বানায় সেই সেতুতে কেউ উঠতে যাবেন না। অনেক রিস্ক আছে। সেই সেতুর ওপর ভরসা করা যাবে না… এই হলো অবস্থা।’ আরেকটি ভাষণে বলেছিলেন : ‘পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে করতে পারবে না তারা। এবং আমরা বলেছিলাম জনগণের কাছে- একটা নয় দুইটা পদ্মা সেতু করব। একটা করব মাওয়া দিয়ে আর একটা পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ওই দিক দিয়ে।’ লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেত্রী ব্যঙ্গচ্ছলে বলেছিলেন : ‘পদ্মা সেতুর সব জিনিসপত্র নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।’ টাকা শুধু থাকলেই চলে না, টাকার সঠিক ব্যবহার জানতে হয়। আর টাকাটা যখন সাধারণের হয় তখন তা ব্যবহারে যতœবান ও দক্ষতারও পরিচয় দিতে হয়। মানবকল্যাণে সাধারণের টাকার সদ্ব্যবহারে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ যে অন্তত কিছুটা বেশি যতœবান ও দক্ষ তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। সে সময় যারা খালেদা জিয়ার ভাষণ শুনে হাততালি দিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেছিলেন আজ তাদের মুখ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পক্ষান্তরে যারা শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রেখেছিলেন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে তাদের মুখ যেন সহস্র সূর্যকিরণে সমুজ্জ্বল। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App