×

মুক্তচিন্তা

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক বাস্তবতায় অর্থনীতির চলমান অস্থিরতা কী খুব অস্বাভাবিক?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ মে ২০২২, ০১:৪৭ এএম

সাম্প্রতিক সময়ে খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়া, সরকারিভাবে ডলারের মূল্য নামানোর চেষ্টা, রেমিট্যান্স ফ্লু কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, অভিজাত ও বিলাসী পণ্য ক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি বিষয় হঠাৎ করে সামনে চলে আসায় দেশের অর্থনীতিতে কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে করে খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, অর্থনীতিতে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এবং সেজন্য নিজের অজান্তেই অনেকের মনে একটা আতঙ্কও তৈরি হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এসব ইস্যুকে সামনে এনে এ আতঙ্ক আরো দ্বিগুণ করে দিচ্ছে। কেননা এগুলোকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলগুলো সফলতা পাবে। এটাকেই বলে ‘কারো সর্বনাশ আবার কারো পৌষ মাস!’ কিন্তু এসব রাজনৈতিক উপস্থাপনায় কতটা বাস্তবতা আছে এবং কতটা রাজনীতি আছে সেটা জানাটা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সামগ্রিক বৈশ্বিক বাস্তবতায় কোভিড-উত্তর পৃথিবীতে সেটা কী আসলেই খুব বেশি অস্বাভাবিক? বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমি এ নিবন্ধে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। এখানে শুরুতেই বলে রাখা জরুরি যে, আমি কোনো অর্থনীতিবিদ নই। অর্থনীতির জটিল গাণিতিক হিসাব-নিকাশের কোনো তত্ত্ব প্রয়োগ করে অর্থনীতির এ অস্থিরতা বোঝার চেষ্টাও আমি করব না। একজন সাধারণ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে, দেশ, সমাজ এবং বিশ্ব ব্যবস্থার ও বাস্তবতার পরিবর্তনশীল প্রবণতাগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি এ অস্থিরতার মূল কারণগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করব এবং এর একটা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এ বিশ্বায়নের যুগের পৃথিবীর চলমান ঘটনা প্রবাহের একটা প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে পড়বে, এটা অনস্বীকার্য। সে কারণেই যখন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে, তখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। ভারত যখন গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন ইউরোপে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় কেননা ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর গম উৎপাদনকারী দেশ। ফলে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়বে এবং এটাই স্বাভাবিক যদিও ভারত বাংলাদেশে গম রপ্তানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। একইভাবে কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি খানিকটা স্থবির এবং মন্থর হয়ে পড়েছিল যা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু প্রায় দুই বছর এ রকম একটি স্থবির অবস্থা কাটানোর পর গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি আবার নতুন করে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে। আবার চাঙ্গা হয়ে উঠছে। ফলে বিশ্বব্যাপী আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন করে গতি সঞ্চারিত হচ্ছে। যেহেতু বিশ্বব্যাপী আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য মোটাদাগে সম্পাদিত হয় ডলারের মাধ্যমে, সেহেতু ডলারের দর ওঠা-নামা করাটা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে একটা সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং ডলারের যে অস্থিরতা সেটা বৈশ্বিক বাণিজ্যের নতুন করে সচল হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্বব্যাপী হাজির হয়েছে। আর অর্থনীতির এ নতুন চাঞ্চল্যকে বলা হচ্ছে ‘পোস্ট-কোভিড ইকোনমিক রিকাভারি’। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি গতিশীলতা, মন্থরতা এবং চাঞ্চল্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখানে আঞ্চলিক বাস্তবতাও মাথায় রাখা জরুরি। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সম্প্রতি বেশ একটা টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। কিছুদিন আগে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতেও বড় ধরনের পালাবদল ঘটেছে এবং ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। শ্রীলঙ্কার অবস্থা আরো কঠিন কেননা শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে রীতিমতো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনো সেখানে বিরাজ করছে। বাংলাদেশেও অনেকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ রকম একটা আঞ্চলিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের কিছুটা ছাপ বাংলাদেশেও পড়বে এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এটাকে অস্বাভাবিক বলে উপস্থাপনার মধ্যে যতটা রাজনীতি আছে, ততটা বাস্তবতা নেই। ফলে যতটা আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, ততটা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ‘পোস্ট-কোভিড ইকোনমিক রিকাভারি’র এ সময়ে অর্থনীতির এ অস্থিরতা খুবই স্বাভাবিক। সরকার এ অস্থিরতা কাটানোর অংশ হিসেবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ডলারের মূল্যমান কমানো। অনেকে এটাকে সমালোচনা করছেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো আমদানিনির্ভর। যার অর্থ হচ্ছে আমরা যতটা রপ্তানি করি, তার চেয়ে অধিক আমদানি করি। জুলাই ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত আমদানি খরচ বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ সেখানে একই সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র ৩৩ শতাংশ। আবার জুলাই ২০২১-মার্চ ২০২২ পর্যন্ত রেমিট্যান্স ফ্লু কমেছে ১৭ শতাংশ। তার মানে একদিকে রেমিট্যান্স কমেছে অন্যদিকে আমদানি খরচ বেড়েছে। আর যেহেতু বেশি বেশি আমদানি করতে হলে, ডলারেই তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়, সেহেতু ডলারের রিজার্ভের ওপর একটা বড় ধরনের চাপ পড়তে বাধ্য। আর এ রকম পরিস্থিতিতে যদি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বেশি থাকে তাহলে আমদানির ক্ষেত্রে অধিক ডলার পরিশোধ করতে হয়। আর অধিক ডলার পরিশোধ করার ফলে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি দেখা দেবে, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর পড়তে বাধ্য। বিগত অর্থবছরের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার আর সেটা এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলারে। ফলে এ রকম একটা পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ডলারের মূল্যমান কমানোর মধ্যে আসলে অযৌক্তিক কিছু নেই। তবে সমষ্টিক অর্থনীতির অনেক পলিসি অনেক সময় ব্যষ্টিক অর্থনীতির সাধারণ অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানে যেটা বোধগম্য সেটা হচ্ছে, গেটা দুনিয়ার অর্থনীতির যে টালমাটাল অবস্থা বাংলাদেশ সেটাকে যথাযথভাবে মোকাবিলার অংশ হিসেবে কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নিয়েছে। যেমন- অভিজাত পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা, সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বাতিল (কেননা এর মাধ্যমে প্রচুর ডলার ব্যয় হবে) এবং আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য ডলারের মূল্যমান কমানো প্রভৃতি। সুতরাং আমার মনে হয়, অর্থনীতির এ অস্থির অবস্থা খুবই সাময়িক। কোভিড-উত্তর পৃথিবী যখন আবার ঘুরে দাঁড়াবে, বিশ্ব অর্থনীতি যখন আবার স্থিতিশীল হবে, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিও আবার স্থির হবে। কেননা বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে। এদেশের হাড়ভাঙা কৃষক, এদেশের অদম্য শ্রমিক এবং প্রবাসী দেশপ্রেমিক শ্রমিকের শ্রমে আর ঘামের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এদেশের অর্থনীতি। এটা এত সহজে ভেঙে পড়ার নয়। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App