×

সারাদেশ

সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি: পানি কমার লক্ষণ নেই বাড়ছে দুর্ভোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি: পানি কমার লক্ষণ নেই বাড়ছে দুর্ভোগ

বিদ্যমান বন্যায় নগরীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জলমগ্ন অবস্থায় দেখা গেছে। ছবি: ভোরের কাগজ

অব্যাহত বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। সুরমা, কুশিয়ারা, সারি ও ধলাই নদীর পানি এখনো বিপদসীমার উপরে থাকায় আগের পাঁচ উপজেলার পাশাপাশি নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরো তিন উপজেলা। এছাড়া সিলেট মহানগরীতেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক। পরিদর্শনকালে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন তারা।

সিলেটের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় বলছে, এখনই পানি নামার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্তত আরো তিনদিন অব্যাহত থাকবে বৃষ্টি। একইসঙ্গে সীমান্তের ওপারেও রয়েছে বর্ষণযোগ্য মেঘমালা। আর তাই আপাতত পানি কমার লক্ষণ নেই। বরং উজানের ঢলে আরো নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে সিলেট মহানগরীর পাশাপাশি গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। একইসময়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে গোলাপগঞ্জ, বিয়ানিবাজার ও ফেঞ্চুগঞ্জের নতুন নতুন এলাকা।

গতকাল বুধবার সকালে সরেজমিনে মহানগরীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও জলমগ্ন অবস্থায় দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। এতে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন নগরবাসী। তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, সরকারি স্থাপনাগুলোতে বন্যার পানি উঠলেও সেবা ব্যাহত হচ্ছে না। সব প্রতিষ্ঠানেরই স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। জেলাজুড়ে বন্যার্তদের জন্য ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ইউএনওদের সার্বক্ষণিক নজরদারি করার নির্দেশনা দেয়া আছে। এছাড়া বন্যাকবলিতদের জন্য দ্বিতীয় দফায় ১০০ মেট্রিক টন চাল এবং তিন হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর আগে ১২৯ মেট্রিক টন চাল ও এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

পাউবো সূত্র জানায়, বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেটের প্রধান নদী সুরমা কানাইঘাট পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে, তবে এখনো তা বিপদসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে সিলেট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে সুনমাগঞ্জ পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশিদ পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন বিপদসীমার ১৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে শেওলা পয়েন্টে নদীটির পানি বেড়েছে আট সেন্টিমিটার, এখন তা বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিয়ানীবাজার উপজেলার নিম্নাঞ্চল। বুধবার সুরমা-কুশিয়ারার পানি বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ১৫০ হেক্টর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও বিয়ানিবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে বুধবার সকাল থেকে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

বিয়ানীবাজার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আহমেদ রাশেদুন নবী জানান, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এখানকার প্রায় ১৫০ হেক্টর ধান পানির নিচে তলিয়ে আছে। সুরমা ও কুশিয়ারার একাধিক পয়েন্টে ডাইক ভেঙে পানি ঢুকছে। ফলে নিম্নাঞ্চলের বহু বাড়ি ও এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কায় উপজেলায় ২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

একই রকম অবস্থা সিলেটের গোলাপগঞ্জের। সুরমা তীরবর্তী বাঘা ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম পানিতে ভাসছে। এসব গ্রামের প্রায় ৬০-৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, পড়েছেন চরম খাদ্য সংকটে। ইতোমধ্যে এ ইউনিয়নের ৪টি স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক শতাধিক পরিবার গবাদিপশুসহ আশ্রয়গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকে আশপাশের এলাকার আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিলেটের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও। দক্ষিণ সুরমা, উপশহরসহ কয়েকটি এলাকার বিদ্যুতের সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় গত মঙ্গলবার থেকে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। এছাড়া বাড়িঘরে পানি ওঠায় কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির। তিনি বলেন, কিছু জায়গায় সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক জায়গার বাসাবাড়ির মিটার পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে।

বজলুর রহমান, দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এখনো গৃহহীন ও পানিবন্দি রয়েছে সহস্রাধিক পরিবার। উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৬০টির বেশি পরিবার গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে ৯টি ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার প্রায় ৪০০ হেক্টর ফসলি জমি ও বীজতলা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। বন্যার কারণে উপজেলার ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ও পানিবন্দি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাংশু কুমার সিংহ জানান, ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ৬টি কেন্দ্রে লোকজন গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে। পানিবন্দি পরিবারগুলোকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল ও শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

শংকর দত্ত, ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি : ছাতকে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গ্রামাঞ্চলের ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। তবে নদীভাঙন এবং ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অনেক মানুষ এখনো আশ্রয়কেন্দ্র এবং বাঁধে অবস্থান করছেন। ত্রাণ সহায়তাও অপ্রতুল। খাবার পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের সংকট। নদী ভাঙন নতুন সংকট তৈরি করছে।

গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাঘাট পানির নিচ থেকে ভেসে উঠলেও কাঁদামাটিতে পরিণত হওয়ায় পায়ে হেঁটে চলাচল করা যাচ্ছে না। ঘরবাড়ি পানির নিচ থেকে ভেসে উঠলেও বসবাস করতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বন্যার পানি নামলেও শিক্ষা কার্যক্রম এখনো স্বাভাবিক হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের উপনির্বাহী প্রকৌশলী তুফিউল ইসলাম তুহিন জানান, ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমা গত মঙ্গলবারের থেকে আজ বুধবার কমে ১ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমে যাবে বলে আশা করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App