×

রাজনীতি

আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দিতে চায় বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২, ০৮:৪৫ এএম

কয়েক মাস আগেও হাতেগোনা গুটিকয়েক নেতাকর্মীকে নিয়ে ‘মুখরক্ষার কর্মসূচি’ পালন করত বিএনপি। সরকারি দলের মন্ত্রী ও এমপিরা কটাক্ষ করে বলত; ‘যে দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামার সাহস নেই; তাদের মুখে আন্দোলন করে সরকার পতনের কথা হাস্যকর শোনায়’। অথচ সেই বিএনপিই এখন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে রাজপথে অনড়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কর্মসূচি পালন করছে। দিচ্ছে সরকার পতনের হুঙ্কার। দলটির নীতি-নির্ধারকরা জানিয়েছেন, দাবি আদায়ে চলমান রুটিন কর্মসূচির বাইরে ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচি আসবে; যেখানে জনগণের সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততার মধ্যে দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।

হঠাৎ করে বদলে গেছে বিএনপি নেতাদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’। প্রতিটি দলীয় কর্মসূচিতে দলবেঁধে ছুটে হাজির হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। সভা সমাবেশে তারা অকপটে সরকারবিরোধী হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, ‘ছাড় দেয়ার আর সময় নেই, আঘাতের পাল্টা জবাব দেয়া হবে’। কেউবা প্রতিরোধের হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, কাউকে বিন্দু মাত্র ছাড় দেয়া হবে না। যেখানেই আঘাত সেখানেই প্রতিরোধ, প্রত্যাঘাত করা হবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির নিজস্ব ফেসবুক পেজে ঢুকলেই দেখা যায়; দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল সভা। তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা করতে প্রতিদিন ২ থেকে ৩টা করে সভা করেন তিনি। অত্যন্ত মোলায়েম কণ্ঠে সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে নেতাকর্মীদের আন্দোলনে রাজপথে নামার আহ্বান জানান। সভা শেষে ‘বাংলাদেশ যাবে কোন পথে; ফয়সালা হবে রাজপথে’ এমন স্লোগান দিয়ে কর্মীদের থেকে বিদায় নেন তিনি।

দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, তারেক রহমানের এই স্লোগানটিকেই মূলমন্ত্র হিসেবে ধরে সরকার পতনের চূড়ান্ত রূপরেখা প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এবারের আন্দোলনকে ‘বাঁচা-মরার’ লড়াই হিসেবে রাজপথে নামার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের। দল পুনর্গঠনের মাধ্যমে আনা হচ্ছে তরুণ নেতৃত্ব। নেতারা জানান, এবারের আন্দোলনের কোনো ‘টাইমফ্রেম’ থাকবে না। মামলা-হামলার মধ্যেও আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, আন্দোলনের বিকল্প ভাবছি না। কারণ, আমরা নিজেদের দাবির কথা বারবারই বলছি। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না। এজন্যই দাবি আদায়ে রাজপথের আন্দোলনে নামব। রুটিনের বাইরে ধাপে ধাপে এমন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আসবে যেখানে জনগণের সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততার মধ্যে দিয়ে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হবে।

তিনি বলেন, আন্দোলন কথাটার অর্থই তো নড়াচড়া করা। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে যখন জনগণ দাঁড়িয়ে যায় তখন কেবল নড়াচড়া না, ভূমিকম্প হয়। সেটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফর্মে আসে। কখনো সেটা প্রতিবাদ সমাবেশ, সমাবেশ কিংবা ধর্মঘট অবরোধের মধ্যে দিয়ে আসে। সুতরাং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিই বলে দেবে কোন ফর্মে সেই আন্দোলন আসবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমাদের স্পষ্ট কথা, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। আমরা এই সরকারের পতন চাচ্ছি। এজন্য আন্দোলনের গতি বাড়াতে আমাদের কৌশল হচ্ছে আঘাত এলে পাল্টা আঘাত হবে।

পরিবর্তন আসছে কর্মসূচির ধরনে : ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বিএনপি জোটের আন্দোলনে দেশজুড়ে হয় চরম সহিংসতা। হরতাল অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ। ২০১৫ তে টানা ৯৩ দিনের হরতালে ফের রাজপথ উত্তাল করে বিএনপি। সে সময়ে আগুন সন্ত্রাসের তকমা লাগে বিএনপির গায়ে। এজন্য দলের নগর কমিটির নেতাদের দায়ী করে আসছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ফলে গত ৭ বছরে ব্যাপক বদলেছে বিএনপির কর্মসূচির ধরন। দলটি এখন সভা সমাবেশে, গণঅনশন, মানববন্ধন, স্মারক লিপির মতো কর্মসূচি দিয়ে জনগণকে আস্থায় এনে গণঅভ্যুথানের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম ঘটাতে চায়। দলটির নেতারা মনে করেন, বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনের ভুলগুলো আর করা যাবে না। বরং এমন কৌশল নিয়ে রাজপথে নামতে হবে যাতে আন্দোলন মুখ থুবড়ে না পড়ে।

আন্দোলনের পেক্ষাপট তৈরি হলো যেভাবে: গত বছরের সেপ্টেম্বরে দলের নির্বাহী কমিটির ম্যারাথন বৈঠক করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আন্দোলনের কর্মকৌশল কী হবে, মাঠ পর্যায়ের সংগঠনকে সক্রিয় করতে কী করা প্রয়োজন, সব বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন তারা। ওই বৈঠকের পরেই চূড়ান্ত আন্দোলনের একটি শক্ত ভিত্তি প্রস্তত করা হয়। এর মধ্যেই র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, সরকারের ব্যর্থতার চিত্র উন্মোচন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু সামনে আসে। এসব ধরেই মামলা ও ধরপাকড়ের মধ্যেই কর্মসূচি চালিয়ে নিতে থাকে দলটি।

সর্বশেষ গত ৩ মে ঈদের দিন বিএনপির সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার বাসা ‘ফিরোজা’য় একঘণ্টা অবস্থানকালে নির্বাচন, আন্দোলনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। সেদিন দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই নেতারা উচ্চকণ্ঠেই সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। নির্বাচনের ব্যাপারেও নিজেদের অনড় অবস্থান জানাচ্ছেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, ঈদের দিন ম্যাডামের সঙ্গে বৈঠকটি ছিল সৌজন্য। তবে তাকে দেখে এতটাই স্বতঃর্ফূত মনে হয়েছে যে, গুলশান কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যেমন দেখতাম ঠিক তেমনই। রাজনীতিতে কোথায় কি মেরুকরণ হচ্ছে সব খবরই তার কাছে রয়েছে।

আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন ও নির্বাচনী প্রস্তুতির সাংগঠনিক লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে কাজ করছে হাইকমান্ড। প্রতিটি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বিভিন্ন অজুহাতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় ছুটে গিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন হাইকমান্ডের বার্তা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। তাদের আলাদা করে প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার মতো প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। তবে আমরা চাই, সেই নির্বাচনটা হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করব।

যে কারণে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত : বিএনপির এবারের আন্দোলনে জামায়াতকে সঙ্গে নিলে বা কোনো ধরনের সম্পৃক্তা থাকলে বাম দলগুলোর পাশাপাশি উদার প্রগতিশীল দলমতের দল ও ব্যক্তিরা সঙ্গে আসবে না এটা জেনে বুঝেই যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তবে বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ দলটির সিনিয়র নেতারা। তাদের ভাষ্য- আগে বৃহত্তর ঐক্য বা জোট গঠন করে আন্দোলনে যেতে দেরি হয়ে যাবে। এর চেয়ে কতগুলো কর্মসূচির ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে রাজপথে ঐক্য গড়ে তোলাই যুক্তিযুক্ত। তারা জানান, যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি রূপরেখা বা কর্মসূচি শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। তবে এর আগে আন্দোলন পরিচালনায় একটি লিয়াজোঁ কমিটি করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App