×

মুক্তচিন্তা

দেশে লঙ্কাকাণ্ড দেখার প্রতীক্ষায় যারা!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২২, ০৩:০১ এএম

একটি বহুল পরিচিত প্রবাদ আমরা শুনে এসেছি ছোটকাল থেকে। প্রবাদটি হচ্ছে, ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা’। একসময় গ্রামে-গঞ্জে এই প্রবাদটি অগ্রজরা প্রায়ই শোনাতেন। বিশেষত যখন কেউ নিজের চরম ক্ষতি করেও অন্যের চলার পথে কাঁটা বিছাতেন কিংবা বাধা দিতেন। এক কথায় অন্যের মঙ্গল কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না এমন মানুষ আমাদের সমাজে কখনো বিরল ছিল না। নিজের সন্তানকে মেরে কিংবা হত্যা করেও প্রতিবেশী কাউকে বিপদে ফাঁসানোর চেষ্টা এ যুগেও অনেককে করতে দেখা যায়। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র মানসিকতা। এটিকে বিচিত্র না বলে বিকৃত বলাটাই শ্রেয় হতে পারে। অন্যের ভালো কিছুতেই সহ্য না করার মানসিকতাকে বিকৃত মানসিকতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। পরিবার ও সমাজে এ ধরনের মানুষ এখনো ঢের দেখতে পাওয়া যায়। শিক্ষাদীক্ষার অভাবই শুধু নয়, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, জীবনবোধ যাদের স্পর্শ করতে পারে না তারা নানা হীনম্মন্যতায় ভোগে, পরশ্রীকাতরতা থেকেও তারা মুক্ত হতে পারে না। তথাকথিত বহু শিক্ষিত মানুষকে প্রায়ই দেখা যায় যারা সহকর্মী কিংবা অগ্রসর চিন্তাধারার কোনো মানুষের গুণাবলিকে কিছুতেই সহজে মেনে নিতে পারছেন না। এটি সমাজের একেবারেই প্রান্তিক থেকে ওপরের স্তর পর্যন্ত সর্বত্রই কমবেশি বিরাজমান। রাজনীতিতেও এর ব্যতিক্রম কিছু দেখিনি। আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক রাজনৈতিক নেতার অবদান তার সহকর্মী কিংবা বিরোধী মত ও পথের ব্যক্তিরা মোটেও সহ্য করতে পারেননি। পরশ্রীকাতরতার নগ্ন প্রকাশ ঘটতে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধুর কথাই ধরুন না কেন? পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে তিনি যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে জীবনপণ লড়াইয়ে নিজে এবং তার বিশ্বস্ত নেতারা জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য না করতেন তাহলে পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাঙালির কাছে কখন ধরা দিত তা কেউ ধারণা করতে পারত কিনা জানি না? বঙ্গবন্ধু, তার দলের অসংখ্য নেতাকর্মী স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বলেই আমরা শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করতে পেরেছি। কিন্তু নির্মম পরিহাসের বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঐতিহাসিক এই ভূমিকাকে ১৯৭১ সালেও অনেকে উপলব্ধি করতে চায়নি, স্বীকার করতে চায়নি, ১৯৭২ এরপরও অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে দ্বিধা করেনি। ’৭৫-এর পর থেকে তো বঙ্গবন্ধুর নাম দীর্ঘদিন ‘নির্বাসিত’ করা হয়েছিল। এখনো সেই অপশক্তি বঙ্গবন্ধু উপাধিটি উচ্চারণ করে না। অকৃতজ্ঞের মতো শেখ মুজিব শেখ মুজিব বলে তাকে শুধু নিচে নামিয়ে ফেলারই চেষ্টা করে না, তার চরিত্র হননেরও চেষ্টা আপাদমস্তকভাবে করে যাচ্ছে। তাদের ভাষায় শেখ মুজিব তেমন কেউ আর কি! তার চেয়ে বড় নেতার দিকে তারা আঙ্গুল তুলে দেখান। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এরপরে এসে শেখ মুজিবকে খামে ঢুকান, পাশে জাতির অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেন। মেজর জিয়ার এক রেডিও ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে যায়! বাংলাদেশ রাতারাতি যেন মুক্ত হয়ে যায়। স্বাধীনতার এমন আজগুবি ইতিহাস যারা ধারণ করে তারা বিকৃত মানসিকতার, জাতিগত পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত রোগী। এই রোগের কোনো ওষুধ এখনো রাজনীতির কারখানায় আবিষ্কৃত হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। স্বাধীনতা ও জাতীয় ইতিহাস নিয়ে যেখানে এত বড় বিকৃত মানসিকতার জায়গা রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছে সেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয় তো একেবারেই ঠুনকো ব্যাপার। প্রতিদিন সেসব বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ চারপাশে রাজনীতির মাঠে ময়দানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই কমবেশি দেখা যাচ্ছে। যেটি স্পষ্ট বোঝা যায় তা হচ্ছে, সমালোচনার নামে পরশ্রীকাতরতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। রাজনৈতিক দল, নেতা, ও সরকার কোনো অবস্থাতেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচনা রাজনীতিতেই শুধু নয়, চিন্তার জগতে, বুদ্ধি, মনন ও প্রতিভার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সমালোচনা করার জন্য বিষয় সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখতে হয়। কোথায় কার কী ভুলত্রæটি, তথ্যপ্রমাণ, যুক্তি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বুঝিয়ে দিতে হয়। প্রকৃত সমালোচক হন একজন বুদ্ধি ও জ্ঞানদীপ্ত মানুষ। ইতিহাসে জ্ঞানদীপ্ত ব্যক্তিরাই অনেক বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই প্রাচীন রোমান সিনেটর সিসেরো আজো অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানদীপ্ত মানুষ হিসেবে স্বীকৃত। ভলত্যেয়ারকে ১৮শ শতকের শ্রেষ্ঠ ফরাসি দার্শনিকই শুধু বলা হয় না, তাকে তার চেয়েও বেশি কিছু ভাবা হয়। কারণ তিনি যুগের পশ্চাৎপদতাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। সমাজ সভ্যতাকে আলোর দিকে নেয়ার জন্য এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেশে দেশে দেয়া যেতে পারে। রাজনীতিতে আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর ’৪৭-উত্তর ভাষণগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করলে দেখা যাবে কত নিখুঁত ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের চরিত্র তিনি তুলে ধরেছিলেন। পাশাপাশি পূর্ব বাংলার জনগণের স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক অধিকারসহ যাবতীয় অগ্রযাত্রার করণীয়গুলো কীভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন। তার বক্তব্যে কোথাও পরশ্রীকাতরতা ছিল না। ছিল না কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। সে কারণেই তিনি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলতে পেরেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও তার কথা শুনব।’ এই উদারতা সেই মানুষটিই দেখাতে পারেন যিনি ব্যক্তিজীবনে সৎ, উদার এবং জাতীয় রাষ্ট্রকে নিয়ে অগ্রযাত্রার চিন্তা করেন, নেতৃত্ব দেন। সে কারণেই তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ নয় বরং রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতেই জনগণকে গড়ে তুলেছিলেন। রাজনীতির এই ধারাটিই হচ্ছে প্রগতিশীলতা ও উদারতাবাদ। এর বিপরীতে ঘৃণা ও বিদ্বেষ যা পশ্চাৎমুখী হতেই কেবল মানুষকে টেনে ধরে। সমাজের এই পশ্চাৎপদতা থেকে অনেকেই মুক্ত হতে পারেন না বলে তারা নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে দ্বিধা করেন না। এই প্রবণতা আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে কতটা প্রকট সেটি বক্তৃতা, বিবৃতি, বিদ্বেষ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের মাত্রাতিরিক্ত বহর দেখে সহজেই অনুমেয়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট তীব্রতর হওয়ার প্রেক্ষাপটে সেই দেশ অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এমন দুঃসময় কখনো আসবে সেটি কেউ ভাবতে পারেনি। এর জন্য সেই দেশের সরকার, নীতিনির্ধারক এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোনো কোনো মহলের দায় রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। শ্রীলঙ্কা যত দ্রুত এই সংকটকাল অতিক্রম করে আবার সেই পুরনো মর্যাদায় ফিরে আসবে ততই দেশটির জনগণের মঙ্গল বলে আমরা মনে করি। সেটি আমাদের একমাত্র কামনা হওয়ার কথা। শ্রীলঙ্কার এই জটিল পরিস্থিতি দেখে আমাদের দেশে অনেকেই বেশ উৎফুল্ল চিত্তে সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে! মাসখানেক আগে যখন হাওরের বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকার ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছিল, তখন অনেককেই বলতে শোনা গেছে এই ফসলগুলো ডুবে গেলেই বাংলাদেশে খাদ্যাভাব অনিবার্যভাবেই ঢুকে পড়বে। তখন শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি এখানেও তৈরি হবেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যানবাহন, গ্রামে-গঞ্জে কিংবা এখানে-সেখানে আলোচনায় তাদের দেখে উৎফুল্ল মনে হচ্ছিল। এর আগে এরাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একইভাবে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছিল। আটা, ময়দা, গম, তেল, গ্যাস সরবরাহ সংকট বাড়তে যাচ্ছে। সুতরাং হাসিনার সরকারও রাজাপাকসে সরকারের মতো ডুবে যেতে বাধ্য হবে। পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকারের পদত্যাগের পরও এদের বগল বাজাতে দেখা গেছে। বিশেষ করে র?্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরা সরকার পতনের হুইসেল প্রায় বাজিয়ে দিচ্ছিল। কয়েক মাস থেকে মেগা প্রকল্প নিয়ে নেতাদের মুখ থেকে এমন সব আজগুবি তথ্য হাজির করাতে শোনা গেছে যে এসব মেগা প্রকল্পের চাপে পড়ে বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হতে যাচ্ছে। কিছু কিছু নেতার মুখে কয়েকটি শব্দ বেশ ঘন ঘন উচ্চারিত হতে থাকে। এর একটি হচ্ছে ফ্যাসিস্টবাদী, অন্যটি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে। শ্রীলঙ্কাও কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে পড়ে আজ এমন দুর্দশায় পড়েছে! শ্রীলঙ্কায় সংসদ এবং সরকার থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এককভাবে প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট। মেগা প্রকল্প কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশীয় বাস্তবতা লাভ-ক্ষতির বিষয়গুলো হিসাব-নিকাশ করে দেখা হয়নি। সেটি জৈব সার গ্রহণের ক্ষেত্রেই বলি কিংবা সমুদ্রবন্দর বা বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নেয়া হোক না কেন। গত দুই বছর করোনায় শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প, চা শিল্প ইত্যাদিতে ধস নেমেছিল। অন্যদিকে ভ্যাট-কর আদায়ে জনতুষ্টিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজস্ব শূন্য করা হলো। বাংলাদেশে কি এ ধরনের কোনো নীতি কৌশল গত এক দশকে গৃহীত হয়েছে? বাংলাদেশে যে কোনো মেগা প্রকল্প যাচাই-বাছাই এবং একনেক অতিক্রম করেই তা গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের রিজার্ভসহ সবকিছুই করোনা-উত্তর বিশ্ব মন্দার কালে অনেক অগ্রসর দেশের মতোই সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানান দিচ্ছে। তারপরও পরশ্রীকাতর দৃষ্টিগুলো শ্রীলঙ্কার লঙ্কাকাণ্ডের আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেই চলছে। দেখা যাক তাদের এই আতঙ্ক ছড়ানোর পরিণতি কী হয়? মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App