×

জাতীয়

শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি সৃষ্টির শঙ্কা নেই, তবে শেখার আছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২, ০৮:৩৩ এএম

শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি সৃষ্টির শঙ্কা নেই, তবে শেখার আছে

শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশেও তৈরি হবে কিনা এ নিয়ে বাহাস চরমে উঠেলেও বিশ্লেষকদের মত বাংলাদেশে এখনই শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ছবি: ভোরের কাগজ

শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশেও তৈরি হবে কিনা এ নিয়ে বাহাস চরমে উঠেছে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সরকারবিরোধীরা ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে বাধ্য। কিন্তু সরকার, অর্থনীতিবিদ ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনই শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে দেশটির সংকট থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে। তবু শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ তুলনা চলছেই।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। চাল, ডাল, ওষুধ, রান্নার গ্যাস কোনো কিছুই পর্যাপ্ত নয়। ফলে রাস্তায় নেমেছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন প্রশ্ন, কেন শ্রীলঙ্কার এই দশা। তবে এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। শ্রীলঙ্কা যে এই অবস্থায় পড়তে পারে তার আভাস মিলেছিল ২০১৯ সালে। সে সময় সরকার গঠনের পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে মাত্র দুটো শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তখন থেকেই কার্যত পরিষ্কার হয়ে যায়, শ্রীলঙ্কার কোষাগার খালি হতে শুরু করেছে। তিনি যে দুটো শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, তার প্রথমটি হচ্ছে ঋণনীতি। তাদের ঋণনীতির কারণেই আজ দেশটি দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এর পরেরটি হচ্ছে কৃষিনীতি। আচমকা কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে দেয়ার পর শুরু হয় জৈবসারের প্রয়োগ। এই আকস্মিক পরিবর্তন শ্রীলঙ্কার কৃষিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলন নেমে আসে অর্ধেকে। মজুত থাকা খাদ্যশস্যে ঘাটতি শুরু হয়। তৃতীয় কারণ হলো- করোনা মহামারিতে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পর্যটকরা শ্রীলঙ্কায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন এই দুদেশের ওপর শস্যের বিষয়ে নির্ভরশীল ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু দুদেশের যুদ্ধের কারণে শ্রীলঙ্কায় সেসব পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া রয়েছে শ্রীলঙ্কার ঋণনীতি। দেশটির সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। শুধু চীনের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি ভারত ও জাপানের মতো দেশ থেকেও ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। ছোট্ট এই দেশটি ঋণের সুদ ও কিস্তি শোধ করতে করতে নিজেদের অর্থভাণ্ডার ফাঁকা করে ফেলে। এই অর্থনৈতিক সংকট এখন রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক সংকটে। তবে আশার কথা হচ্ছে, দেশটিতে অভিজ্ঞ রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এখন দেখার পালা, তিনি দেশকে এই সংকট থেকে কীভাবে বের করে আনেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দুদেশের অর্থনীতির দুর্বল দিক একই- স্বল্প কর, রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং স্বল্প পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। তবে, বাংলাদেশের হাতে এখনো শ্রীলঙ্কার মতো বিপর্যয়ে না পড়ার মতো যথেষ্ট সময় আছে। জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্ক। সম্প্রতি একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছেন, অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকতে থাকা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। কেউ কেউ শ্রীলঙ্কার জায়গায় বাংলাদেশকে বসিয়ে রায় দেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। দুদেশের সমাজ ও অর্থনীতি ভিন্ন। তাদের মূল্যায়ন তারা করবেন। আমরা সতর্কতার সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি পরিচালনা করি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেন, আন্দোলন ও নির্বাচনে ব্যর্থতার দায়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে এখন শ্রীলঙ্কা দ্বীপে পৌঁছেছেন। তার মতে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না। কেননা, এ দেশ ঋণগ্রস্ত নয়, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকেও ঋণ দিয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও সদরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, সরকার যেভাবে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, তাতে শ্রীলঙ্কার মতো হতে বাধ্য বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবস্থা অচিরেই শ্রীলঙ্কার মতো হবে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বাঘ এলো, বাঘ এলো বলে ওরা খামোখা ভয় দেখাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের আকাশ-পাতাল তফাত।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সি এম শফি সামি গত শুক্রবার একটি অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশের অবস্থা এখনো শ্রীলঙ্কার মতো হয়নি। তবে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা থেকে বাংলাদেশের অনেক শেখার রয়েছে। তাই বাংলাদেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাতমূলক পরিস্থিতি পরিহার করে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসা জরুরি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো মিল আছে বলে মনে করি না। তবে এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্য সব দেশ শিক্ষা নিতে পারে। এক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। মেগাপ্রকল্প বা বিনিয়োগগুলো যেন সুশাসনের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে ও সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো থেকে যে আয় আসবে তার প্রাক্কলন এবং সেগুলোর ঋণ পরিশোধের প্রাক্কলনের মধ্যে যেন সামঞ্জস্য থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪১ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে আমরা পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারব। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার তা দুই বিলিয়ন ডলারেরও কম। যা দিয়ে এক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা চলে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে থাকা শ্রীলঙ্কা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিদেশি ঋণের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে, ১৯৯৭ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যায় দেশটির। ফলে অর্থের জন্য অন্য উৎসের খোঁজ করতে হয় তাদের। আর তাতেই দেউলিয়া হতে শুরু করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের এখনো বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার মতো বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নেয়ার সুযোগ আছে।

বেসরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটি গাড়ি যখন উঁচু থেকে নামার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখন যত নিচে নামতে থাকে পতনের গতি তীব্র হতে থাকে এবং এ বিষয়ে আর কিছুই করার থাকে না। তবে, আমরা এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি। ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে চলেছে। তাই, ২০২৭ সালের মধ্যেই দেশটির বিশেষ সুবিধার ঋণ পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারকে এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যদি দ্রুত রপ্তানিতে বৈচিত্র্য না আনতে পারি, তাহলে সমস্যায় পড়ব। কেবল রেমিট্যান্সের কারণে আমাদের রিজার্ভ বেশি। কিন্তু, রেমিট্যান্সের এ অবস্থা সবসময় থাকবে না। কাজেই সব ধরনের প্রকল্পের জন্য ঋণ না নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App