×

মুক্তচিন্তা

রবার্ট ম্যালপাস, রবার্ট ম্যালথাস

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২২, ১২:৩১ এএম

একজন টমাস রবার্ট ম্যালথাস ১৭৯৮ সালে ‘অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অব পপুলেশন’ প্রকাশ করে পৃথিবীকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন- খাবারের অভাবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিণতি হবে ভয়াবহ, অসুখ-বিসুখ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের মৃত্যু অনিবার্য। ২২৪ বছর পর ডেভিড রবার্ট ম্যালপাস ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রায় কাছাকাছি স্বরে অনাহার ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলেছেন। দুজনের নামের মধ্যাংশ রবার্ট এবং শেষাংশেরও রয়েছে ধ্বনিগত মিল : ম্যালপাস ও ম্যালথাস। ম্যালথাসের জন্মের ১৯০ বছর পর রবার্ট ম্যালপাসের জন্ম। ম্যালথাস ব্রিটিশ অর্থনৈতিক দার্শনিক, জনসংখ্যা তত্ত্বের জন্য যুগপৎ প্রশংসিত ও বিতর্কিত। তিনি বিশ্বখ্যাত, অর্থনীতির নবিস শিক্ষার্থীও তার নাম জানেন। ম্যালপাসও বিশিষ্ট মার্কিন অর্থনীতিবিদ, যথেষ্ট পরিচিত নাম। ২০০৭-২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস তিনি দিয়েছিলেন। ২০১০ সালে তিনি রিপাবলিকানদের হয়ে সিনেটে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জনপ্রিয়তায় ঘাটতি ছিল বলে ভোটের দৌড়ে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। এখন তিনি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত, ২০১৯ থেকে ৫ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৩তম প্রেসিডেন্ট। উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে। তিনি আগেভাগেই ২০১৯-এর জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন। চীনবিরোধী বলে ম্যালপাসের পরিচিতি আছে, চীন ও চীনের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অসংযমী ভূমিকার তিনি কট্টর সমালোচক ছিলেন। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের একটি ফলাফল তুলে ধরেছেন, এই যুদ্ধের ফলে বড় ধরনের খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে ‘মানবিক বিপর্যয়ের’ মুখে পড়েছে বিশ্ব। তার সতর্কবার্তা : খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে খাদ্যবঞ্চিত করছে, পুষ্টিগ্রহণ হ্রাস পাচ্ছে এবং তাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিপর্যয় মোকাবিলায় হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্যসামগ্রী এবং কৃষি সহায়ক দ্রব্য যেমন সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে তিনি সরকারগুলোকে জরুরি বার্তা দিয়েছেন। এ ধরনের সংকটে বিশ্বব্যাংকের নিস্পৃহতা ও নিষ্ক্রিয়তার নজির আছে, ম্যালপাসকে ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। রবার্ট ম্যালথাস ১৭৯৮ সালে যে পৃথিবী কল্পনা করেছিলেন তাতে প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে তিনি গ্রাহ্য করেননি। একালে খাদ্য নিয়ে যেসব মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে, তার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্যের অপ্রতুলতা নয়, বিতরণের অদূরদর্শিতা এবং ধনী দেশের ঔদাস্য এবং ভুক্তভোগী দেশগুলোতে শাসক এলিটদের দুঃশাসন ও অমানবিকতা। রবার্ট ম্যালথাস কি দেখেছিলেন তা ফিরে দেখা যায়। টমাস রবার্ট ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪) ডেভিড রবার্ট ম্যালপাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক তৈরির হেইলবারি কলেজের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হিসেবেই পৃথিবীতে খ্যাত হয়ে উঠেন রেভারেন্ড টমাস রবার্ট ম্যালথাস। তিনি ইতিহাস ও রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রফেসর। তার পাঠের অন্যতম ফোকাস মানুষ এবং ক্রমবর্ধমান মানুষ। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রশ্নেই হোক কি উন্নয়নের প্রশ্নে জনসংখ্যাকে হিসাবে না এনে বাস্তব চিত্র পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তার প্রিয় ছাত্ররা ঠাট্টা করে নয়, শ্রদ্ধাভরেই তাকে বলতেন পপ ম্যালথাস। ম্যালথাসের বিশ্বস্ত জীবনীকার হ্যারিয়েট মার্টিনু লিখেছেন, সামাজিক কল্যাণ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে ম্যালথাস অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন, অথচ তিনিই সবচেয়ে বেশি গালি খেয়েছেন। আর শুরু থেকে বিভিন্ন সময় তাকে চিত্রায়িত করা হলো- দানব ম্যালথাস, শয়তান ম্যালথাস, পাশবিক ম্যালথাস, আওলা মাথার ম্যালথাস, জঘন্য ম্যালথাস, শিশুবিদ্বেষী ম্যালথাস। মেধাবী রবার্ট ক্যামব্রিজের জিসাস কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান। ১৭৯১-তে এমএ ডিগ্রি নেন এবং দুই বছর পর জিসাস কলেজে ফেলোশিপ পান। তারপর চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রত্যয়ন গ্রহণ করে ওকউড চ্যাপেলের ধর্মযাজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৭৯৮ সালে তিনি বহুল বিতর্কিত ‘অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অব পপুলেশন’ প্রকাশ করার পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। গ্রন্থের সঙ্গে লেখকের নাম ছাপা হয়নি, কিন্তু কাজটি যে রবার্ট ম্যালথাসের, তা ফাঁস হতে সময় লাগেনি। এতে ভয়ানক বিষণ্ন এক ভবিষ্যতের চিত্র উঠে এসেছে। রবার্ট ম্যালথাস বললেন, মানুষ বাড়ে জ্যামিতিক হারে (২, ৪, ৮, ১৬, ৩২…) আর খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে (২, ৩, ৪, ৫, ৬…) আর প্রতি ২৫ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। যেহেতু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়বে, নষ্ট হবে ভারসাম্য, এনে দেবে দুর্ভিক্ষ। খাবার না পেয়ে বাড়তি জনসংখ্যা বিলীন হয়ে যাবে। অবধারিত এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি দুই ধরনের প্রতিরোধকের কথা বলেছেন, প্রথমটি পজিটিভ; এর আওতায় পড়ে দুর্ভিক্ষ, অসুখ-বিসুখ ও মহামারি এবং যুদ্ধ। আর দ্বিতীয়টি প্রিভেন্টিভ বা নিরোধক; এর মধ্যে রয়েছে- গর্ভপাত, জন্মনিয়ন্ত্রণ, পতিতাবৃত্তির সম্প্রসারণ, কৌমার্য ধরে রাখা, বিয়ে পিছিয়ে দেয়া। ম্যালথাসের সময় পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১ বিলিয়ন, ২৫ বছর পর তা ২ বিলিয়নে পৌঁছবে। তিনি বলেছেন, খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় যদি শ্রমিকের সরবরাহ বেড়ে যায়, তাহলে প্রকৃত মজুরি কমে যাবে, জীবনধারণ ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে সংসার প্রতিপালন দুরূহ হয়ে উঠবে আর তা জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিহত করতে সাহায্য করবে। খাদ্য উৎপাদন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির অসামঞ্জস্যপূর্ণ খতিয়ান শেষ পর্যন্ত ডেকে আনবে ‘ম্যালথাসিয়ান ক্যাটাস্ট্রোফ’- ম্যালথাসীয় ধ্বংসযজ্ঞ। এ রকম অনিবার্য ধ্বংসযজ্ঞের কথা রবার্ট ম্যালথাস না লিখলেও অর্থনীতিবিদ জুলিয়ান সাইমন এ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ম্যালথাস বরং জনসংখ্যার গতিশীলতার একটি অভিব্যক্তিবাদী সামাজিক সমাধান দিতে চেষ্টা করেছেন। তার ১৭৯৮ সালের রচনায় আটটি বিষয় উঠে এসেছে : ১. ‘নিতান্ত প্রাণ ধারণ স্তরের’ অর্থনীতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি সীমিত করে আনে। ২. নিতান্ত প্রাণ ধারণ স্তরের উন্নতি ঘটলে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ অন্যান্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রণোদনা প্রদান করে। ৪. উৎপাদন বৃদ্ধি আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। ৫. যেহেতু উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, পৃথিবীর ধারণক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য কঠোরভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হবে। ৬. যৌনতা, কাজকর্ম এবং সন্তানসন্ততির ব্যাপারে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসাবই সংসার বড় হবে না সংকুচিত হবে, তা নির্ধারণ করে। ৭. জনসংখ্যার চাপ নিতান্ত প্রাণধারণ স্তর পেরিয়ে গেলেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের স্বয়ংক্রিয় বিষয়গুলো কাজ করতে শুরু করে। ৮. এই নিয়ন্ত্রণের বিশেষ প্রভাব পড়বে বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ওপর। (ম্যালথাস সামাজিক অনাচার, বিপন্নতা ও দারিদ্র্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।) জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে যে ম্যালথাসীয় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্রকল্প আমাদের সামনে উঠে এসেছে, তাতে এ অর্থনীতিবিদ-দার্শনিককে ‘প্রোফেট অব গøুম’ বলা যেতেই পারে। ক. খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ধরা যাক দ্বিগুণ, আর মানুষের সংখ্যা বেড়েছে চৌষট্টি গুণ- এক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষ তো অনিবার্য, খাবারের জন্য যুদ্ধ এড়ানোরও কোনো উপায় নেই, অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যের কারণে মহামারির প্রকোপে বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ থাকার কথা নয়। পৃথিবী সসীম, ধারণক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। ম্যালথাস যে দ্রুততায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বাস্তবে তা ছিল আরো শ্লথ (আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশ বাদে)। অন্যদিকে ম্যালথাসের গাণিতিক হারকে টেক্কা দিয়ে খাবারের উৎপাদন বেড়েছে অবিশ্বাস্য রকম অধিক হারে। কাজেই যে নারকীয় যজ্ঞ দেখার সম্ভাবনা ছিল, তা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। বরং ম্যালথাসের আমলের তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক বেড়ে যায়। খ. প্রযুক্তির শক্তি ও প্রভাব এবং মানুষের উদ্ভাবন শক্তি তিনি অবমূল্যায়ন করেছেন। গত শতকের ষাটের দশকে বিজ্ঞানী নরম্যান বোরলাগের তত্ত্বাবধানে যে সবুজ বিপ্লব ঘটে গেল, তাতে পপুলেশন বুম কিংবা গøুম মোকাবিলা সহজ হয়ে উঠল। রবার্ট ম্যালথাস আবার হেরে গেলেন। গ. ম্যালথাস খাদ্য ও জনসংখ্যাকে যে নিক্তিতে মেপেছেন, তার হিসাব যদি সত্যি হতো, তবে তার নিজ দেশ গ্রেট ব্রিটেন দুর্ভিক্ষে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি কেবল খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিয়েছেন। সব ধরনের উৎপাদন হিসেবে আনলে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়টি মাথায় রাখলে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব হয়তো ভিন্নরূপে আবির্ভূত হতো। ঘ. ‘নিতান্ত প্রাণ ধারণ স্তরের’ অর্থনীতি থেকে উত্তরণ ঘটলে ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরো বেড়ে যাবে। ফলে আবারো তারা কেবল প্রাণ ধারণ অর্থনীতির স্তরে নেমে আসবে। সোজা কথা, জনসংখ্যা বেড়ে গেলে মানুষ কোনোভাবেই নিতান্ত প্রাণ ধারণ স্তরের মানের ওপরে উঠতে পারবে না। কার্যত ঠিক উল্টোটি ঘটেছে। জীবনমান বৃদ্ধি পেলে জন্মহার বেড়ে যাবে- এ রকম নজির বলতে গেলে নেই-ই। বরং অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে, জীবনমান উন্নত হলে জন্মহার দ্রুত কমে যেতেই দেখা যায়। আর্থিক সমৃদ্ধি শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। ইউরোপ-আমেরিকায় সন্তান জন্ম দিয়ে নিজেদের জন্য ভোগান্তি ডেকে আনতে অনেকেই রাজি নন। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ম্যালথাসের জনসংখ্যা জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে। ঙ. জনসংখ্যা বৃদ্ধির জ্যামিতিক এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির গাণিতিক পরিসংখ্যান ম্যালথাস তথ্য দিয়ে সমর্থন করাতে পারেননি। এই দুই বৃদ্ধির কোনোটাই কোনো নির্দিষ্ট জ্যামিতিক বা গাণিতিক প্যাটার্নকে অনুসরণ করে না। ম্যালথাসের জীবদ্দশায় তার এ মৌলিক রচনার ছয়টি সংস্করণ হয়েছে। তিনি পরবর্তী কোনো সংস্করণে এ সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবের সমর্থনে নতুন কিছু বলেননি বরং বলেছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্বভাবতই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়। ম্যালথাসের জনসংখ্যাতত্ত্বে ভয়ার্ত ভবিষ্যদ্বাণী টমাস কার্লাইলকে ভাবিয়েছে; তার কারণেই তিনি অর্থনীতির নাম দিয়েছেন বিমর্ষ বিজ্ঞান। বিরোধিতা করেছেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তার আউটলাইন অব আ ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি (১৮৪৪) গ্রন্থে; কার্ল মার্ক্সেরও একই সুর; ১৮৬৭-তে প্রকাশিত ক্যাপিটাল-এ তিনি ম্যালথাসের জনসংখ্যাতত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছেন। এঙ্গেলস এতটাই চটেছিলেন যে, তাকে লিখতে হয়েছে- পৃথিবীতে বিদ্যমান সব তত্ত্বের মধ্যে এটিই দ্য ক্রুডেস্ট এন্ড দ্য মোস্ট বার্বারাস। ম্যালথাসের ডকট্রিনের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে, তার একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হলো : ক. তত্ত্বের গাণিতিক হিসাবটি ভুল। খ. তিনি তার তত্ত্বে এতটাই বন্দি যে, নতুনের আগমনও আগ্রাহ্য করছেন। গ. একটি অনড় অর্থনৈতিক আইনের অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন। ঘ. জনগণের ভেতর যে ‘ম্যানপাওয়ার’ আছে, তা উপেক্ষা করেছেন। ঙ. বুঝতে পারেননি যে, জনসংখ্যা কেবল খাদ্যের সঙ্গে জড়িত কোনো বিষয় নয়। চ. মৃত্যুহার হ্রাস পাওয়া যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ, তা বিবেচনায় আনেননি। ছ. জনমিতি বিশারদরা দেখিয়েছেন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত; আয় বাড়লে জন্মহার কমে যায়। জ. ম্যালথাস চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির সম্ভাবনা তখন অনুধাবন করতে পারেননি। ঝ. মূলত ধার্মিক ও ধর্মযাজক হওয়ায় জোর দিয়েছেন নৈতিক সংযমের ওপর। জন্ম নিরোধকের ব্যাপক ব্যবহার তিনি কল্পনা করতে পারেননি। তার চিন্তায় যৌনতার সঙ্গে অনিবার্যভাবে শিশুজন্ম জড়িয়ে ছিল। ঞ. ঐশ্বরিক নিয়ন্ত্রণের বিষয় সর্বত্র প্রযোজ্য হয়নি। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে পৃথিবীর বোঝা হিসেবে মনে করেছেন এবং ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনসংখ্যা হ্রাস করে ভারসাম্য আনবে বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু জনসংখ্যা যেখানে পড়তির দিকে; সেই জাপান, জার্মান ও ফ্লান্সেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। ট. ম্যালথাসের কালের তুলনায় জনসংখ্যা অন্তত সাত গুণ বেড়েছে; একই সঙ্গে অনাহার-মৃত্যুর সংখ্যাও তখনকার তুলনায় কমে এসেছে। সুতরাং ম্যালথাস এবং তার তত্ত্বকে কি উড়িয়ে দেয়া যাবে? বলাবাহুল্য, জনসংখ্যাতত্ত্ব ম্যালথাসের অনেকগুলো কাজের একটি মাত্র। তার তত্ত্বের যথার্থতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বিশ্বব্যাংকের ম্যালপাসও ভুল বলেননি, খাদ্যের সংকটই প্রধান মানবিক সংকট।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App