×

অর্থনীতি

রপ্তানি পণ্যের বহর বাড়ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২২, ০৮:২২ এএম

রপ্তানি পণ্যের বহর বাড়ছে

প্রতীকী ছবি

মাইলফলকের ঘরে টেক্সটাইল, কৃষি এবং চামড়াজাত পণ্য

করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও দেশের রপ্তানি খাত নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে। নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সফল হয়েছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি দীর্ঘদিন ধরে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। অথচ যে কোনো একটি খাতের ওপর অতিনির্ভরশীলতা অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। কারণ, পোশাক রপ্তানি কমে গেলে পুরো অর্থনীতিই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তবে দেরিতে হলেও পোশাকের পর একসঙ্গে তিনটি খাতের পণ্য রপ্তানি ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে। এগুলো হচ্ছে- হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এছাড়া, পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিও শত কোটি ডলার ছুঁইছুঁই করছে। এ ধারাবাহিকতায় আরো আছে প্রকৌশল পণ্য ও হিমায়িত খাদ্য। রপ্তানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা মহামারির পরে এ ধরনের অর্জন সত্যিই অর্থনীতির জন্য অনেক বড় সুখবর। আমাদের নতুন নতুন খাত যেমন- ঔষধ, আইটি, কৃষি খাত- এগুলো যখন নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, তখন বোঝা যাচ্ছে রপ্তানির স্থায়িত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এটা অবশ্যই অনেক ভালো লক্ষণ। তিনি বলেন, আরো একটি সুসংবাদ হচ্ছে, রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১০ মাসেই অর্জন হয়েছে। তবে এটাকে রপ্তানির সঠিক গ্রোথ হিসেবে ধরে নেয়া ঠিক হবে না। কারণ বিশ্বে পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। তাই দেখতে হবে, আগে কী পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আর এখন কী পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক খাতে ভর করে রপ্তানি এগোচ্ছে। তবে অতিমাত্রায় কারো উপরে নির্ভরশীল হলে তার স্থায়িত্ব ভালো থাকে না। তাই পণ্যের ডাইভারসিফিকেশন বা বহুমুখীকরণ যত বাড়বে, রপ্তানি তত স্বাস্থ্যবান ও স্থায়ী হবে। নতুন যে খাতগুলো এগিয়ে আসছে, এসব পণ্যগুলোকে আরো বেশি যত্ন নিতে হবে। এছাড়া যত ফিনিশড প্রোডাক্ট হবে, রপ্তানি তত মানসম্মত হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত ভোরের কাগজকে বলেন, অনেকদিন থেকেই আমরা চেষ্টা করছি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ বাড়ানোর। পোশাক খাতের ভেতর এবং বাইরেও চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, আমাদের কৃষিপণ্যের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে। আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে চামড়া খাত। যদিও এ খাতের জন্য আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। ট্যানারি পল্লীর সিইটিপি আমরা এখনো কার্যকর করতে পারিনি। তাই রপ্তানিতে বৈচিত্র্যতা ফিরছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এতে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। রপ্তানির এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে পোশাক খাতের মতো অন্য রপ্তানিমুখী খাতগুলোকেও একই সুবিধা দিতে হবে। যেমন ব্যাক টু ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়্যার হাউস, ডিউটি ফ্রি এক্সেস ইত্যাদি। এসব সুবিধা দিলে সম্ভাবনাময় অনেক পণ্যই রপ্তানিতে ভালো করতে পারবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সব মিলিয়ে করোনা মহামারির পর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য রপ্তানিতে ভালো করেছে বাংলাদেশ। তাতে দুই মাস বাকি থাকতেই চলতি অর্থবছরের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার কাছাকাছি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। দেশীয় মুদ্রায় যা পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকার সমান। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। সবকিছু ঠিক থাকলে পণ্য রপ্তানি চলতি অর্থবছর শেষে ৫ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছে যাবে। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। করোনা সংক্রমণের বিস্তৃতির কারণে পরের দুই বছরে রপ্তানি কম হয়।

দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৪০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার সমান। গত এপ্রিলে পণ্যের রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো. ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগ বাংলাদেশের রপ্তানি খাত দুভাবে নিতে পারে। প্রথমত, সীমিতভাবে ক্রয়াদেশ বেশি নিতে পারেন উদ্যোক্তারা। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করা। এজন্য আগামী দিনের পণ্যের উৎসের হাব হিসেবে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। কারণ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পেট্রো কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, চামড়া, হালকা প্রকৌশল, সিরামিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, তৈরি পোশাকবহির্ভূত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বাজারভিত্তিক, পণ্যমানভিত্তিক ও শুল্কবহির্ভূত বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করা বিশেষ প্রয়োজন। তিনি বলেন, সব পণ্যের বাজারে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা খুব সীমিত আকারেই রপ্তানি বাড়াতে পারছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। অপ্রচলিত প্রায় প্রতিটি বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ, যেমন-চীন বা ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা পর্যাপ্ত আকারে ব্যবহার করতে পারে না। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে স্যানিটারি ও ফাইটো স্যানিটারি স্ট্যান্ডার্ড পরিপালন গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষিতে মাইলফলক : চা, শাকসবজি, ফলমূল, মসলাসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি প্রথমবারের মতো শতকোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১০৪ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছর এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতেই গত বছরের চেয়ে ১৮ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

স্বরূপে ফিরছে চামড়া খাত : চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বেশ কয়েক বছর পর শত কোটি ডলারের ঘরে ফিরেছে। পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর এ খাতের রপ্তানি কমতে থাকে। গত দুই বছর রপ্তানি ছিল শতকোটি ডলারের নিচে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১০১ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

এগিয়েছে হোম টেক্সটাইল : হোম টেক্সটাইল রপ্তানি গত অর্থবছর ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছায়। চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার দুই মাস আগেই গত বছরের রপ্তানিকে ছাড়িয়ে গেছে হোম টেক্সটাইল খাত। গত ১০ মাসে ১৩৩ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে। এ আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি।

সম্ভাবনাময় অন্য খাত : কয়েকটি সম্ভাবনাময় খাত রপ্তানিতে ভালো করছে। এদের মধ্যে অন্যতম এক সময়ের সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি টানা দুই বছর পর গত অর্থবছর শতকোটি ডলারে পৌঁছায়। চলতি বছরও সেই ধারা বজায় থাকবে। কারণ, এখন পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ৯৭ কোটি ডলার।

শীর্ষ ধরে আছে পোশাক খাত : রপ্তানিতে বরাবরের মতো শীর্ষস্থানে রয়েছে তৈরি পোশাক। গত এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। শুধু এপ্রিলেই ৩৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৫৬ শতাংশের মতো। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই আগামী বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের। ইতোমধ্যে ক্রয়াদেশের হার কিছুটা পড়তির দিকে। আগামী জুন-জুলাই থেকেই রপ্তানি আয়ে তা প্রকাশ পাবে। রপ্তানি ধরে রাখতে উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্যোগ অপরিহার্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App