×

মুক্তচিন্তা

প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডার কেন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ মে ২০২২, ০৪:১৩ এএম

৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার ৮২ জন, কুয়েট থেকে ৬৪ জন, রুয়েট থেকে ৫৯ জন এবং চুয়েট থেকে ৫৫ জন। সম্প্রতি ৪০তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারি কর্মকমিশন সরকারের কাছে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করেছে- যেখানে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান প্রকৌশলীদের। উল্লেখ্য, অতীতের অন্য সব বিসিএস পরীক্ষার নিয়ম আমূল পরিবর্তন করে শুধু মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর এটিই প্রথম ব্যাচ। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে যারা এই ৪০তম বিসিএসের মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা প্রকৃতই মেধাবী। প্রশ্ন হচ্ছে এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করে ইতোমধ্যে সুনামের সাক্ষর বহন করে চলেছেন, তারা কেন প্রশাসক হতে চাচ্ছেন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের যে সুযোগ-সুবিধা ও হাঁক-ডাক সমাজে বিরাজ করছে সেই অনুপাতে মেধাবী প্রকৌশলীদের দেশে মূল্যায়ন নেই। আর সে কারণেই মূলত এসব মেধাবী সন্তানরা এমন পরিস্থিতির শিকার। বর্তমান বাস্তবতায় প্রশাসন, পুলিশ এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারই চোখে পড়ার মতো এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে বলা যায় শক্তিশালী। আমাদের মেধাবী চিকিৎক ও প্রকৌশলীরাও তাদের নিজেদের দক্ষতানির্ভর পেশায় না গিয়ে এই পদগুলোর দিকে ঝুঁকছেন। সৎ উপায়েই যদি বলি তাহলে একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কি একজন প্রশাসন ক্যাডারের চেয়ে কম উপার্জন করেন? বরং অনেক বেশি করেন। প্রশাসন ক্যাডারের কেউ সৎ উপায়ে একজন ডাক্তারের চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারেন না। এবার একজন প্রশাসন ক্যাডারের সৎ কর্মকর্তা কি নিজে গাড়ি কিনতে পারেন? পারেন না। পুলিশ অফিসার পারেন না। একটা পর্যায়ে গিয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি কিংবা জয়েন্ট সেক্রেটারি হন, পুলিশে যারা এসপি বা ডিআইজি হন তখন সেই সক্ষমতা অর্জন করেন। তবে বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের একটি আলাদা সুযোগ আছে, সেটি হচ্ছে দেশের বাইরে বিদেশে ভ্রমণ ও চাকরির বহু সুযোগ থাকা। আর সরকারি টাকায় দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগটিকে সবাই পছন্দ করবেন এটিই স্বাভাবিক। একজন ডাক্তার যদি সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালেও চাকরি করেন, তাহলে তার মানবসেবা করার চরম সুযোগ রয়েছে। অসহায় ও যন্ত্রণায় কাতরানো একজন রোগীর উপশমের চেষ্টা করছেন তিনি, স্রষ্টার সৃষ্টির অপার কারুকার্য তার চোখের সামনে ভাসে। এক দাঁত কিংবা চোখের ওপর সারাজীবন পড়াশোনা ও গবেষণা করেও একজন ডাক্তার তার কূলকিনারা করতে পারেন না। তার চিন্তা, ধ্যান, ধারণা, গবেষণা ওই মানুষের শরীর, শরীরের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূল্য, কাজ এবং স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করার মাঝে অন্য কিছুর চিন্তা আসা মানে হচ্ছে তিনি পেশার প্রতি অতটা যতœবান নন। একজন ডাক্তার প্রশাসনে গিয়ে ফাইল চালাচালি করা, আটকাআটকি করা আর নিম্নস্থদের ধমকাধমকি করা, স্যার স্যার সম্বোধন শোনা আর সাধারণ মানুষদের ভয়-ভীতি দেখানোর মধ্যে কি মজা আছে বুঝতে কষ্ট হয়। একজন ইঞ্জিনিয়ারের মনের মাধুরী মিশিয়ে কত নকশার কত ডিজাইনের বিল্ডিং তৈরি করার, নতুন নতুন সৃষ্টি করার নেশায় মত্ত থাকার কথা। তিনি প্রশাসন ক্যাডারে গিয়ে কোথায় কাজে লাগাবেন তার অর্জিত জ্ঞান? অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগে যারা পড়াশোনা করছেন, ক্লাসে শিক্ষকদের কথা শুনছেন, পত্র-পত্রিকা পড়ছেন এসব বিষয় ক্রিটিক্যালি থিংক করছেন, বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি পড়ছেন, কমপক্ষে বিদেশি একটি ভাষা শিখেছেন তারা যদি পররাষ্ট্র ক্যাডারে না যান তাহলে একজন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিংবা কৃষিবিদ ওই ক্যাডারে গিয়ে কতটা অবদান রাখবেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রথম অনেক বছর তো সে অর্থে অবদান রাখতেই পারবেন না। শেষের দিকে হয়তো রাখবেন। একজন ডাক্তারের মেধা আছে, একজন কৃষিবিদের মেধা আছে, একজন শিক্ষক যিনি একটি বিশেষ বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন তার মেধা আছে, কিন্তু এক বিষয়ের মেধা অন্য বিষয়ের কাছে শিশুতুল্য। যেমন একজন কৃষিবিদের কাজ একজন ইঞ্জিনিয়ার করতে পারবেন না। প্রশাসন ক্যাডারেও তাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। প্রশাসন ক্যাডারের আর পুলিশ ক্যাডারের সাময়িক দাপট দেখে সমাজে একটি অন্যরকম ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একজন প্রশাসন ক্যাডারের এন্ট্রি লেভেলের কর্মকর্তা কি আগের মতো সুবিধা ভোগ করেন? তিনি কি উপজেলা পর্যায়ে প্রভাবমুক্ত হয়ে কোনো কাজ করতে পারেন? অথচ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা হয়ে উঠেছে বিসিএসমুখী। শিক্ষার্থীরা প্রথমবর্ষে ঢুকেই এক দুটি বিসিএস গাইড কেনেন। সেটির প্রতি তারা যতটা গুরুত্ব দেন বিভাগীয় পড়ায় ততটা মনোযোগী নয় কারণ কিছু নোট, ক্লাস টেস্ট দিয়ে পরীক্ষা পার করে ডিগ্রিটা নেয়া উদ্দেশ্য। মুখ্য উদ্দেশ্য বিসিএস অফিসার হওয়া। খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী যারা যে বিষয় পড়ছেন সেই বিষয়ের গভীরে ঢুকছেন। অর্থাৎ পড়া ও জানার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা সমাজ পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের সে রকম দর্শনই কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃত জ্ঞানার্জন বিমুখতা। তারা তা করবেনই বা কেন- পরিবার, সমাজ, দেশ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে কখন তারা কী করবেন। আত্মীয়-স্বজন যখন শোনে যে, ছেলে বিসিএস করে এএসপি হয়েছেন কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন তখন সবাই বাহবা দিতে থাকেন, আর প্রার্থীর নিজের তো একটি চাহিদা, চাওয়া-পাওয়া ও সোশ্যাল স্ট্যাটাস দরকার। আর এই বিসিএস সমাজে ও বিয়ের বাজারে যতটা সম্মান এনে দিচ্ছে ততটা আর কোথাও না এমনকি কোনো বিষয়ে বিদেশ থেকে পিএইচডি করে আসলেও সেভাবে কেউ দেখে না। এটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি আর এজন্য এককভাবে কেউ দায়ীও নয়। সবাই কমবেশি দায়ী। তবে যারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণীতে থাকেন তাদের ওপর দায়টা একটু বেশি। কিন্তু তাদের কি আবার এসব চিন্তা করার সময় আছে? যখন ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররা গণহারে পেশা বদলের চয়েস দেন তখন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষিবিদ্যার স্নাতকরা তাদের পেশাগত বিদ্যার বলয় ছেড়ে কেন বেরোতে চাচ্ছেন? উত্তর হচ্ছে পেশাগত জীবনে চরম আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। যে কোনো বিষয় থেকে এসে প্রশাসন আর পুলিশ ক্যাডারে ঢুকে যে দাপট প্রদর্শন করতে পারেন, যে সুযোগ-সুবিধা পান, সেটিতে একজন প্রকৌশলী বা ডাক্তার বা কৃষিবিদ কেন ভাগ বসাতে যাবেন না। তাকে তো বিশেষায়িত বিষয়ের কথা বলে বসিয়ে রাখা যাবে না। তাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে বিচার করছে? অর্থাৎ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ঠিক থাকছে না। তাই বিশেষায়িত বিষয়ের স্নাতকধারীরা গণহারে যাচ্ছেন আন্তঃক্যাডার বৈষম্যে মোকাবিলা করতে, সমাজকে উচিত শিক্ষা দিতে। যে সমাজ চায় না যে, ডাক্তাররা রোগীর সেবা করুক, যে সমাজ চায় না কৃষিবিদরা কৃষির দিকে না তাকিয়ে পুলিশ হোক, যে সমাজ চায় প্রকৌশলীরা প্রকৌশলবিদ্যা কাজে না লাগিয়ে ফাইল চালাচালি করুক- সে সমাজে তো আমরা এসব পেশাজীবীকে দোষ দিতে পারি না। মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App