×

জাতীয়

বেপরোয়া মোটরসাইকেল সামাল দেয়ার উপায় কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২২, ০৯:১০ এএম

বেপরোয়া মোটরসাইকেল সামাল দেয়ার উপায় কী

এবারের ঈদে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ যাত্রী মোটরবাইক চালকরা পরিবহন করেন

নিয়ন্ত্রণহীন মোটরসাইকেল। সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলের কারণে দুর্ঘটনার বেশির ভাগই সংঘটিত হয়েছে। অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল কীভাবে চলছে, তার ওপর সংশ্লিষ্টদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল শুধু রাজধানীতে চলার কথা থাকলেও এখন তা কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে। গত শনিবার রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এপ্রিল মাসের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, সড়কে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই ঘটেছে ১৮৯টি। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে গত ৬ দিনে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ২৫০ জনেরও বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, এদের ৩০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। তাদের অনেকেরই হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে।

এবার ঈদযাত্রায় সারাদেশে মোটরবাইক চালকরা যাত্রী পরিবহন করেছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল বাংলাবাজার ও শিমুলিয়া ফেরিতে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি করে। সড়ক পরিবহন নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, মূলত দেশে অ্যাপসভিত্তিক রাইড সার্ভিস পরিচালনার অনুমতি দেয়ার পর থেকেই দেশে মোটরসাইকেল আমদানি, বিক্রি ও এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মোটরসাইকেল নামছে রাস্তায়।

সারাদেশে বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ মোটরসাইকেল চলাচল করছে। রাজধানীবাসীর যাতায়াত সহজতর করা এবং বেকারত্বের হার কমানোর লক্ষ্যেই অ্যাপসভিত্তিক মোটরবাইক চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু এখন এই মোটরসাইকেল মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ে পরিণত হয়েছে। অ্যাপসভিত্তিক রাইড সার্ভিস পরিচালনার অনুমতির সুযোগ নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণরা মোটরসাইকেল কিনে ঢাকায় চলে এসেছে বেকারত্ব ঘোচাতে। ফলে রাজধানীর সড়কে মোটরবাইকের চাপ বেড়েছে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও অদক্ষ চালকরা ট্রাফিক আইন মানছেন না। সড়কের যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে যানজটের সৃষ্টি করছে। অ্যাপসভিত্তিক রাইড সার্ভিসের নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে সবাই চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহন করছে। চালকরা ভাড়ার চুক্তিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করছে। সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিসংখ্যানে এখন ট্রাকের পরেই মোটরসাইকেল অবস্থান নিয়েছে। ২০২১ সালে সারাদেশে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনায় পড়ে। এর ঠিক পরের অবস্থানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ মাসে ১৭৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২১ জন নিহত হয়। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে ২ শতাধিক।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, মোটরসাইকেল সড়কে ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ যেন মোটরসাইকেল কিনতে না পারে সে বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা থাকাটা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। মোটরসাইকেলের চাপ কমাতে সাময়িকভাবে বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্তও নেয়া যেতে পারে। সব মোটরসাইকেলে মানসম্পন্ন দুটি হেলমেট থাকতে হবে। এসব ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। এছাড়া অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল চলাচলে সরকারের আরো কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। অ্যাপসের বাইরে কেউ যেন মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সাইফুন নেওয়াজ আরো বলেন, মোটরসাইকেল এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সড়ক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চলাচল আর মেনে নেয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণে বিশেষ জোর দিতে হবে। আমাদের এখন আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতা নিতে হবে। সব সড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে মনিটরিং করতে হবে। তাহলেই একটি দুর্ঘটনা ঘটলে এর কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। কার দোষে দুর্ঘটনাটি ঘটল তা সহজেই জানা সম্ভব হবে। কিন্তু আমাদের সব সড়কে এখনো প্রযুক্তির ব্যবহার হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে মামলা হয়, কিন্তু বেশির ভাগ মামলারই তদন্ত সঠিকভাবে হয় না।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, এপ্রিল মাসে সড়কে ৪২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত ও ৬১২ জন আহত হয়েছে। শুধু ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৬ জন। এই সংখ্যা মোট নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। অপ্রাপ্ত বয়স্ক, অদক্ষ ও যুবকদের বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে সাধারণ পথচারী নিহতের সংখ্যাও বেড়েছে। অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল কীভাবে চলছে, তাতে সংশ্লিষ্টদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে মোটরসাইকেল চালকরা দিন দিন মহাসড়কে আরো বেপরোয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পাশাপাশি গণপরিবহনের সুষ্ঠু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। ঈদ যাত্রায় দেশের জাতীয় মহাসড়কে ২০ থেকে ২৫ লাখ মোটরসাইকেল রাস্তায় থাকবে। এসব মোটরসাইকেলে স্ত্রী-সন্তান লাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেপরোয়াভাবে বাস ও প্রাইভেট কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল রাস্তায় যানজট প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ২০২১ সালের কুরবানির ঈদে ৩১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত ৬২২ জন আহত হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেলে ১৪৪টি দুর্ঘটনায় ১৩৯ জন নিহত ও ১৯৯ জন আহত হয়েছিল। এবারের ঈদে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ যাত্রী মোটরবাইক চালকরা পরিবহন করেন। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও ৩ গুণ বেড়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভবিষ্যতে ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল চলাচল কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা অপরিহার্য বলে মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App