×

সাহিত্য

রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন, কুঠিবাড়ি থেকে রাজধানী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২২, ০৯:৪৫ পিএম

রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন, কুঠিবাড়ি থেকে রাজধানী

বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ বিশ্ববরেণ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন বিশ্বজনীন বাঙালি। তার সৃষ্টি বাঙালির মননে চিরন্তন অনুরণন জাগায়। তাকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয়, ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তারই মাধ্যমে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তার দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি (ম্যালেরিয়া) বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি। তেমনি এক ব্যাধি করোনা মহামারীর কারণে গত দু’বছর কবির জন্মতিথি ছিল অন্তর্জালিক বা ভাচুর্য়াল আয়োজনে সীমাবদ্ধ। তবে এ বছর উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে বহুমাত্রিক এবং বণার্ঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই বরেণ্য কবির জন্মোৎসব উদযাপন হচ্ছে। বাঙালির এমন পরম আরাধ্যজনের জন্মতিথিতে তারই নামে শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ি থেকে রাজধানীর মঞ্চে মঞ্চে কথামালায়, কবিতায়, গানে, চিত্রাংকনে, নাট্য উৎসবের মধ্য দিয়ে হৃদয় উৎসারিত ভালোবাসার অর্ঘ্য ঢেলে দেয়া হয়েছে।

ছায়ানট কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রবীন্দ্র চচার্র নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ছায়ানট দুইদিনব্যাপী রবীন্দ্র—উৎসবের আয়োজন করেছে। গতকাল ছিল প্রথম দিনের অনুষ্ঠানমালা। প্রথম দিনের পরিবেশনার প্রথমেই হে নূতন, দেখা দিক আর—বার, মোরা সত্যের ’পরে মন, নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে, সম্মেলক নৃত্যের পরিবেশনা ছিল ছায়ানটের শিল্পীরা। ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’ সম্মেলক নৃত্যের পরিবেশনায় ছিল ছায়ানটের শিল্পীরা। একক নৃত্যের পরিবেশনায় ছিলেন অমিত চৌধুরী। একক পাঠ পর্বে অংশ নেন লিয়াকত খান এবং একক পাঠ/আবৃত্তি পরিবেশান করেন জয়ন্ত রায়। একক গানের পর্বে ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’ পরিবেশনায় ছিলনে রোকাইয়া হাসিনা নীলি, ‘পূর্ণ—আনন্দ পূর্ণমঙ্গলরূপে’ গানে মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য, ‘জানি জানি কোন্ আদিকাল হতে’ গানে সুতপা সাহা, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে’ গানে চঞ্চল বড়াল। এছাড়াও একক গানের পরিবেশনায় ছিলন সেমন্তী মঞ্জরী, আব্দুল ওয়াদুদ, ফারহিন খান জয়িতা, সত্যম্ কুমার দেবনাথ, সুমা রায়, দীপ্র নিশান্ত, সুস্মিতা আহমেদ বর্ণা, পার্থ প্রতীম রায়, মাকছুরা আখতার, মেজবাহুল আযম মঞ্জু ও সেঁজুতি বড়ুয়া। আজ দুইদিনের অনুষ্ঠানের সমাপনী ও শেষ দিনের আয়োজনে থাকবে নানা পরিবেশনা।

শিল্পকলা একাডেমি বিশ্বকবির জন্মদিনে বাংলাদেশ শিল্পকলা আয়োজনে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আর্টক্যাম্প ও চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। সন্ধ্যায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একাডেমির চারুকলা বিভাগের ব্যবস্থাপনায় কবির অংকিত ৪৫টি চিত্রকর্মের রেপলিকা এবং কবিকে নিয়ে অংকিত ৭৯টি চিত্রকর্ম নিয়ে জাতীয় চিত্রশালায় দশ দিনব্যাপী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রদর্শনী সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে।

প্রদর্শনীতে বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত আর্টক্যাম্প থেকে নির্মিত ৫৫টি চিত্রকর্ম যুক্ত হবে। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালাসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশের ৫টি স্থান কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। দেশবরেণ্য শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শিল্পী আবুল বারাক আলভী, শিল্পী আব্দুল মান্নান, শিল্পী বিরেন সোম, শিল্পী ফরিদা জামানসহ ৫৫জন চিত্রশিল্পীর সমন্বয়ে আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে।

এ ছাড়া বিকালে জাতীয় চিত্রশালার ২ নং গ্যালারিতে একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক মিনি করিমসহ বরেণ্য চিত্রশিল্পীদের নিয়ে আর্টক্যাম্প ও চিত্রকর্ম প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। সন্ধ্যায় আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আলোচক ছিলেন প্রফেসর ড. আনোয়ারুল করীম, মঞ্চসারথি নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যদলের পরিবেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ শিরোনামে সমবেত নৃত্য। পরিবেশিত হয় সববেত নৃত্য ‘ঐ মহামানব আসে’ এবং ‘বিপুল তরঙ্গ রে’। শিশু দলের পরিবেশনায় সংগীত ও নৃত্য ‘আন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ ,‘আলো আমার আলো’ এবং ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত’ পরিবেশিত হয়। ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ’ এবং ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি’ শিরোনামে সমবেত নৃত্য পরিবেশিত হয়। একক সংগীত পরিবেশন করেন অনিমা রায়, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, লাইসা আহমেদ লিসা, বুলবুল ইসলাম, সালমা আকবর, মহিউজ্জামান চৌধুরী, শাহনাজ নাসরীন ইলা, কামাল আহমেদ, রোকাইয়া হাসিনা এবং আজিজুর রহমান তুহিন।

নজরুল ইন্সটিটিউট সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে নাচে গানে এবং আবৃত্তি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বিশ^কবির ১৬১তম জন্মদিন উদযাপন করল নজরুল ইন্সটিটিউট। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত সংস্কৃতি সচিব সাবিহা পারভিন। শুরু স্বাগত বক্তব্য দেন নজরুল ইন্সটিটিউটের নিবার্হী পরিচালক মোহাম্মদ জাকীর হোসেন। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী বুলবুল ইসলাম, অনিমা রায়, আজিজুর রহমান তুহিন, শিমু রানী দে, সুপনার্ হাসান, সুমা রায় ও নির্ঝর চৌধুরী। নৃত্য পরিবেশন করেন কবিরুল ইসলাম রতন ও তার দল, ওয়াদার্ রিহাব ও তার দল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন রূপা চক্রবতীর্ ও শাহাদাৎ হোসেন নিপু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘মানবতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিষ্মদেব চৌধুরী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। আলোচনা সভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নৃত্যকলা বিভাগের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গভীর অনুরাগী এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল রয়েছে উল্লেখ করে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সকল মহামানবের চিন্তা এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়।

তিনি বলেন, মানবতার সংকট নিরসনে প্রাচ্যের প্রতি যে প্রত্যাশা ছিল রবীন্দ্রনাথের—তা পূরণে বঙ্গবন্ধু ভূমিকা রেখেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে কারণে আজ এই দুই মহামানবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। কেননা, সব মহামানবের চিন্তা এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়, সকল উদার চিন্তা এক জায়গায় গিয়ে মেশে, সব উদার চিন্তাই শাশ্বত। ড. বিষ্মদেব চৌধুরী মূল প্রবন্ধে বলেন, মানবতার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সহায় রবীন্দ্রনাথ। এ কারণে ১৫০ বছর পরও রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার জীবনাবসান ঘটে।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের অনুসারী ছিলেন। এখন পর্যন্ত এমন কোনও দলিল পাওয়া যায়নি যে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছিলেন, তবে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। তিনি তার গান শুনতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের জাতীয় সংহতির প্রণেতা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App