করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সফল- এমন স্বীকৃতি অনেক আগেই মিলেছে। তবে অদৃশ্য এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য প্রকাশের পর বির্তকের মধ্যে এলো তেমনই একটি সুখবর। এবার করোনা পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে বিশ্বে ৫ম ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানের স্বীকৃতি মিলেছে বাংলাদেশের। বৃহস্পতিবার জাপানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিকেই এশিয়া প্রকাশিত ‘নিকেই কোভিড ১৯ রিকোভারি সূচকে’ এই তথ্য উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়, করোনা সামলে ওঠার ক্ষেত্রে বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে যে দেশগুলো সবচেয়ে ভালো করছে, সেই তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা, টিকাদান এবং এই মহামারি মোকাবিলায় সামাজিক তৎপরতার ওপর ভিত্তি করে এই সূচক প্রকাশ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাজুক স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যেও সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণেই এই সফলতা এসেছে। এর মধ্যে টিকাদান, স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও বিভিন্ন প্রণোদনা বেশ কার্যকর ফল দিয়েছে।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে তো বটেই; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বের অনেক দেশ এবং প্রতিষ্ঠানও করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সফল- এমন স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১ সালে বৈশ্বিক মহামারি করোনা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। মার্চ মাসে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। গত বছর অক্টোবর মাসে জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তহবিলের (ইউএনপিএফ) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. আশা তোরকেলসন করোনা নিয়ন্ত্রণে সুইডেন-ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো সক্ষমতা দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
গত বছরের নভেম্বরে মালদ্বীপ সফর কালে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এ সময় করোনা মহামারি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন ফয়সাল নাসিম। ১০ ডিসেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করে বিশ্বব্যাংক। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারাবাহিকতা চোখে পড়ার মতো। মহামারি বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপের ফলে করোনাকে প্রতিহত করে বর্তমানে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আমেরিকান সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)’র আঞ্চলিক প্রধান ডা. নিলি কায়েডোস ড্যানিয়েলস জানান, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকার আওতায় এসেছে। যা প্রশংসার দাবিদার। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশেরও প্রশংসাও করেন তিনি।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকরাও বলছেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ভালো করেছে। এই সফলতার পাবার পেছনে রয়েছে সরকারের সময়োপযোগী বেশ কিছু উদ্যোগ। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা গড়পরতা ভালোই করেছি। ভালো না করলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যখন সংক্রমণের হার খুব বেশি সেখানে আমাদের দেশে সংক্রমণ হার এত কম কেনো? আমাদের সংক্রমণের হার ১ শতাংশের কম। মার্চ মাসের শেষ দিকেই সংক্রমণের হার ১ শতাংশের নিচে নামে। পুরো এপ্রিল মাস এবং এখনো পর্যন্ত সেটি অব্যাহত রয়েছে।
দেশে করোনা প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচির প্রসংশা করে বিশিষ্ট এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, শুরুর দিকে টিকাদান কর্মসূচিতে একটু সমস্যা হলেও সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সংকট কাটিয়ে উঠে চমৎকারভাবে টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে টিকার বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে টিকা নিয়েছে। এ কারণেই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের তুলনায় আমরা এক্ষেত্রে ভালো করেছি। এছাড়া নতুন একটি ভাইরাস প্রতিরোধের পন্থাগুলো (রোগী শনাক্ত পদ্ধতি, সংক্রমিতদের ওপর কোনো ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হবে, মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করা) যখনই সামনে এসেছে বাংলাদেশ কিন্তু সেই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক বেশি সক্ষম না হলেও সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা ভালোই করেছি। মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের ‘নো মাস্ক; নো সার্ভিস’ কর্মসূচিটিও প্রসংশার দাবিদার। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিনামূলে মাস্ক-স্যানিটাইজার বিতরণের উদ্যোগও দেখা গেছে।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অগ্রগামী এবং সম্পদ বেশি এমন অনেক দেশের তুলনায় আমরা করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভালো করেছি। সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার শুরুর দিকে লকডাউনসহ কঠোর নির্দেশনা দেয়। এরপর কয়েক দফা বিধিনিষেধও আরোপ করে। এসব বিধিনিষেধ সাধারণ জনগণ কতটা মেনেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একে একে সংক্রমণের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ সামলে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের এসব উদ্যোগ শুধু সংক্রমণ প্রতিরোধেই সফল হয়নি; করোনাকালে দেশের অর্থনীতিও সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। লকডাউনের সময় নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা যেমন জীবিকা রক্ষা করেছে; তেমনি ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের জন্য দেয়া বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে দেশের অর্থনীতির গতিও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।