×

অর্থনীতি

ফিকে হচ্ছে নিজ বাড়িতে মাথা গোঁজার স্বপ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২২, ০৮:৩৬ এএম

ফিকে হচ্ছে নিজ বাড়িতে মাথা গোঁজার স্বপ্ন

রিহ্যাব। ফাইল ছবি

ভবন তৈরির অন্যতম কাঁচামাল ইট আমদানি করতে হয় না। তবুও দাম বাড়ছে। মাসখানেক আগে ভালো মানের প্রতি পিস ইটের দাম ছিল ১০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে সাড়ে ১১ টাকা। ইট উৎপাদনকারীদের অভিযোগ, কয়লার দাম বাড়ার কারণে ইটের দাম বাড়ছে। বড় কোম্পানিগুলো এখন সিমেন্ট আর ইটের ব্যবসায় নেমেছে। এ কারণে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এক বছর ধরে কয়লা আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে কয়লার দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে দুশ্চিন্তা বাড়ছে আবাসন খাতে। রিহ্যাব বলছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতে স্থবিরতা নেমে আসবে বিভিন্ন সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে চলমান কাজেও। সংগঠনটি দাবি করছে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে প্রতি বর্গফুটে তাদের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ৭৪০-৮০০ টাকা। রিহ্যাব নেতারা বলছেন, অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ ও হস্তান্তর প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন ফ্ল্যাট বিক্রিও কমেছে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে আবাসন খাতের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, নির্মাণসামগ্রীর বাড়তি দাম। হঠাৎ করেই দাম এত বেড়েছে যে, যে কোনো ডেভেলপারের পক্ষেই সেটাকে একোমোডেট করা সম্ভব নয়। সুতরাং ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানো ছাড়া ডেভেলপারদের বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন এসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। আর তাই ফিনিসড মেটেরিয়ালে এর প্রভাব পড়েছে। যে কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। শামসুল আলামিন বলেন, আমি মনে করি, সরকারের উচিত এখনই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। বাজারে সিন্ডিকেট হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারি না। বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তারা মনিটরিং করে দেখুক আন্তর্জাতিক বাজারে দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কিনা। রিহ্যাব সভাপতি বলেন, ফ্ল্যাট তৈরির আগেই আমরা সেগুলো বিক্রি করি। তাই হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাওয়াতে ডেভেলপাররা প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সময়মতো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারবেন কিনা এ বিষয়েও সংশয় রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উত্তর বা কোনো বৈঠক এখনো হয়নি বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স এসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও রাজা এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোনিয়াম খান বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি কয়লা আমদানি করছে। তারা মর্জিমতো কয়লার দাম বাড়াচ্ছে। এ কারণে ইটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে দাম বেশি নিতে হচ্ছে। দাম বাড়ার তালিকায় আছে বালু-পাথরও। ১০-২০ টাকা বেড়ে প্রতি বর্গফুট লাল বালু ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ টাকা বেড়ে সাদা বালু বিক্রি হচ্ছে ১৫-২৫ টাকায়। ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক যুগের মধ্যে পাথরের দাম এখন সর্বোচ্চ। দুই মাস আগে প্রতি বর্গফুট পাথর পাওয়া যেত ১৮৫-২০৫ টাকায়। এখন দাম ২৩৫-২৫০ টাকা। ভবন তৈরির পর দরকার হয় গøাস, অ্যালুমিনিয়াম, হার্ডওয়্যার জাতীয় পণ্য। বাজারে এসব পণ্যের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী। ২০২০ সালে প্রতি বর্গফুট থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম ছিল ২৫০ টাকা, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৪২০ টাকা। গ্রিল ও রেলিংয়ের দাম প্রতি বর্গফুট প্রায় ৪৩ শতাংশ বেড়ে ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। স্যানিটেশনে ব্যয় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত পিভিসি ও ইউপিভিসি পাইপ-ফিটিংস, দরজা, সিলিং ইত্যাদি পণ্যের দামও গত কয়েক মাসে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

রড, সিমেন্ট, ইটের পাশাপাশি বেড়েছে নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম পণ্য সিরামিক। বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে সিরামিক শিল্পে ৭৮টি কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। বছরে বিক্রি ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। রপ্তানিও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটে পড়েছে কনস্ট্রাকশনের অন্যতম উপাদান সিরামিকস টাইলসের উৎপাদনও। মূল কাঁচামাল ক্লে ও গ্যাসের সরবরাহ সংকট এবং মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের সিরামিকস শিল্প সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আমরা প্রতিযোগী মার্কেটের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছি। বাংলাদেশে সিরামিকস উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৯৫ শতাংশই আমদানি হয়। গত এক বছরে এসব পণ্যের ক্লে, কেমিক্যালসহ সব পণ্যের দামই ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। এখন নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে গ্যাস ও ক্লে-এর দাম বৃদ্ধির। দেশে সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত ক্লে-এর বড় অংশই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি থেকে আমদানি হয় জানিয়ে গ্যাসের দামকেই বড় সংকট মনে করছেন সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। তিনি বলেন, সিরামিকস গ্যাসনির্ভর প্রসেস ইন্ডাস্ট্রি। ক্লিন বা চুল্লিতে ফায়ারিংয়ের কারণে ২৪ ঘণ্টাই গ্যাস চালু রাখতে হয়। গ্যাসের প্রবাহও উচ্চমাত্রায় রাখতে হয়। গ্যাস সংকটের কারণে এখনই অনেক কারখানা ঠিকমতো উৎপাদন অব্যাহত রাখতে না পেরে লোকসান গুনছে।

লাগাতার বাড়তে থাকা নির্মাণ খরচের চাপ কুলিয়ে উঠতে না পেরে স্বপ্নের বাড়ি তৈরির কাজ শুরুর আগেই থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। পেশাজীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে সাড়ে তিন কাঠা জমিতে বসবাসের জন্য বাড়ি নির্মাণের কাজ হাতে নিয়ে কেবল ফাউন্ডেশন পর্যন্তই থেমে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, ধারণা করেছিলাম সব মিলিয়ে ৪৫-৪৮ লাখের মধ্যে ভবনের ফাউন্ডেশন শেষ করতে পারব কিন্তু নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ হয়ে গেছে ৫৪ লাখেরও বেশি টাকা। নুরুল ইসলাম বলেন, বাড়ির কাজ শুরুর সময় একেএস রডের টন ৬৮ হাজার টাকায় পেলেও তা মাঝে দাম বেড়ে হয় ৭৫ হাজার টাকা। রডের দাম ৮৮ হাজার ছাড়ানোর পর কাজ থামিয়ে দিয়েছি। এখন দাম ৯২ হাজারে কাছাকাছি। আগে এক ট্রাক ইট ২৭ হাজার ৫০০ টাকায় পেয়েছি। এখন ৩২ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ট্রাকপ্রতি যমুনা বালুর দাম ৫ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, সাড়ে ৬ হাজার টাকার নিচে পাকশি বালু পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছরের মাঝামাঝি পাথর প্রতি বর্গফুট ১৮৫ টাকায় পেলেও ফেব্রুয়ারিতে কিনেছি ২৪০-২৫০ টাকায়। এত চড়া বাজারে বাড়ি করা সম্ভব না।

এ অবস্থায় আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রাইভেট) লিমিটেডও ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, গৃহ নির্মাণসামগ্রীর বাজারদর এখন পর্যন্ত ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়াও আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে বাড়তে পারে ফ্ল্যাটের দাম। শেলটেক ইতোমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি। আবার কিছু এলাকা ও প্রকল্পের মানভেদে দাম বাড়ানো হয়নি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে, সেই চিন্তা করে নতুন কোনো প্রকল্পের কাজ শুরু আপাতত বন্ধ রয়েছে। যুদ্ধের অবস্থাসহ আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নতুন প্রকল্পগুলোতে ভবন নির্মাণের কাজ করা হবে বলে জানান তানভীর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App