×

জাতীয়

প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার ৩৩ হাজার ঘর হস্তান্তর আজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৯:০১ এএম

প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার ৩৩ হাজার ঘর হস্তান্তর আজ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নির্মাধীণ ঘর

সড়কের পাশে সরকারি খাস জমিতে ছিল শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের কিছুদিন পর রাস্তা প্রশস্তের কাজ শুরু হয়। ভেঙে ফেলা হয় ঘরের বেশির ভাগ অংশ। অল্প একটু জায়গায় শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী ও ২ সন্তানকে নিয়ে মাথা গোঁজাই ছিল দায়। এরই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ উচ্ছেদের খবরে অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠতো মন; কবে যেন ঘরের উপর বুলডোজার চালানো হয়- এই দুশ্চিন্তায় পালিয়ে যেত ঘুম। এমন পরিস্থিতিতে আলোর দিশা হয়ে আসে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প। মাস তিনেক আগে স্বামী-সন্তান নিয়ে বরগুনা সদরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্বপ্নের ঠিকানায় সংসার পেতেছেন আঁখি নামের এই গৃহবধূ। এখন আর উচ্ছেদ আতঙ্ক নয়, দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। শুধু আঁখিই নয়, বরগুনার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রত্যেকটি পরিবারের রয়েছে ঠিকানাহীন মানবেতর জীবনযাপনের ভয়ংকর অতীত ও নতুন করে স্বপ্ন বোনার গল্প। সেই সঙ্গে প্রথমবার স্থায়ী ঠিকানায় আসন্ন ঈদ পালনের উচ্ছ্বাসের অপেক্ষাতো আছেই। সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে নতুন ঘর পেতে যাওয়া মানুষের মধ্যে বাঁধভাঙা আনন্দের পাশাপাশি দেখা গেছে সীমাহীন স্বস্তিও।

বরগুনা ছাড়াও সারাদেশের সব জেলা-উপজেলায় গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প। আজ মঙ্গলবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্প-২ এর তৃতীয় ধাপে নির্মাণ করা আরো প্রায় ৩৩ হাজার ঘর জমির মালিকানাসহ গৃহহীনদের কাছে হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী। আগের মতোই এসব বাড়িতে রয়েছে সেমিপাকা থাকার ঘর, কিচেন, টয়লেট ও টিউবওয়েল।

প্রকল্প-২ এর আওতায় হস্তান্তর হতে যাওয়া এসব ঘরের মধ্য একটি ঘর পেতে যাচ্ছেন বরগুনা সদরের গৌরিচন্না ইউনিয়নের বাসিন্দা শারীরিক প্রতিবন্ধী বিল্লাল হোসেন (৩২)। তার জন্মের কিছুদিন পরই মারা যান বাবা খানদে আলী। জন্মগতভাবে দুই সন্তান প্রতিবন্ধী হলেও হাল ছাড়েননি মা। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে তাদের বড় করে তোলেন। বড় ভাই হানিফ চায়ের দোকান চালিয়ে আর বিল্লাল ভিক্ষা করে সংসারের হাল ধরেন। ভিক্ষায় যে টাকা পেতেন প্রতি মাসে তা থেকে ২ হাজার চলে যেত ঘর ভাড়ায়। কিন্তু কষ্টের দিন ঘুচতে যাচ্ছে বিল্লালদের। আজ মঙ্গলবার আশ্রয়ণ প্রকল্পের নতুন ঘর পেতে যাচ্ছেন তারা। স্বপ্নের ঠিকানা পেয়ে বিল্লালের চোখে মুখে রাজ্যের খুশি ভর করেছে। এতদিন বিয়ের কথা না ভাবলেও, ঘরে ওঠার পর মায়ের পছন্দে বিয়ে করবেন বলে জানান। আলাপচারিতায় বিল্লাল ভোরের কাগজকে বলেন, ‘এহন জীবন ভালো চলবো, সবকিছু ভালো হইবো।’ জমিসহ বাড়ি দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন বিল্লাল।

নতুন ঘরে ওঠার আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে গৃহবধূ আঁখি বলেন, এখন থাকার স্থায়ী জায়গা আছে। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব। আর কেউ চাইলেই তাড়িয়ে দিতে পারবে না। এখন ছেলেদের মানুষের মতো মানুষ করব। বড় ছেলে ওলিউল্লাহকে (৬) ইঞ্জিনিয়ার ও দেড় বছর বয়সি ছোট ছেলে ইসহাককে শিক্ষক বানানোর স্বপ্নের কথা জানান তিনি।

আঁখিদের ঘরের পাশেই নতুন ঘর পেতে যাচ্ছেন জাহেদা বেগম। স্বামীর কোনো জায়গা-জমি না থাকায় বিয়ের পর থেকেই দক্ষিণ লাকুরতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ১৫ বছর আগে রিকশাচালক স্বামীর মৃত্যুর পর চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। বরগুনা শহরে গাজী কিচেন নামে একটি হোটেলে রান্নার কাজ নেন। প্রতিদিন ২০০ টাকা আয়ে সংসার চালানোই যেখানে কঠিন, সেখানে দুই ছেলেকে মানুষ করবেন কীভাবে- এই চিন্তায় বিভোর থাকতেন জাহেদা। অভাবের তাড়নায় বড় ছেলে আলামিনকে লেখাপড়া করাতে না পারলেও স্বপ্ন ছিল ছোট ছেলে রুহুল আমিনকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু করোনা শুরুর পর আয় কমে যাওয়ায় অভাব চরম আকার ধারণ করে। ফর্মফিলাপের টাকা দিতে না পারায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি রুহুল আমিন। এখন স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ার খবরে আবারো নতুন করে স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে জাহেদা বেগমের মনে- আর ঘর ভাড়া দেয়া লাগবে না, ওই টাকায় ছেলেকে পড়ালেখা করাবেন। আগামীবার ছেলেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়াবেন। নিজের বাবার বাড়ি থেকে কোনো সম্পদ পাননি? এমন প্রশ্নের জবাবে জাহেদা বলেন, জমি থাকলে তো আর সরকার এখানে ঘর দিত না। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর চাচার কাছে মানুষ হইছি। চাচা কিছুই দেয়নি। আমার স্বামী আবদুল কালামেরও কোনো রকম জমিজমা ছিল না।

প্রধানমন্ত্রীর এই মহতী উদ্যোগ থেকে বাদ যাননি নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠানো গোলাম মোস্তফা মন্টুও। ছেলেরা বিদেশে গিয়ে দিন ফেরাতে না পারলেও মানবেতর জীবনযাপনের কষ্ট অনেকটা লাঘব করে দিয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া স¤প্রদায়কেও এই প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে। আগে সমাজ যাদের ঘৃণার চোখে দেখতো, এখন তাদের সঙ্গেই মিলেমিশে চলছে দিন। সেই সঙ্গে স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ার পর চেয়েচিন্তে নয়, আর ১০ জনের মতোই জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন হিজড়ারা। কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেক গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষও।

মৌসুমী নামে এক হিজড়া ভোরের কাগজকে জানান, অন্য সবার থেকে আলাদা বলে খুব ছোট বেলায়ই তাকে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে আসতে হয়েছিল। পরিবারের লোকজনই যেখানে তাকে নিজেদের কাছে রাখেনি সেখানে অন্য কারো কাছে তার কখনো কোনো আশা ছিল না। একেক সময় একেক জায়গায় বসবাস করে তাকে জীবনের অধিকাংশ সময়ই পার করে দিতে হয়েছে। ঘর পেয়ে মনে হচ্ছে আমরাও মানুষ- এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরাও এই সমাজেরই অংশ। আমরাও সম্মান, ভালোবাসা পেতে পারি। এটা শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।

বরগুনার প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, খাজুরতলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে মোট ৩২৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩য় ধাপে নির্মিত ৫০টি ঘর আজ মঙ্গলবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী। একই দিন পুরো বরগুনা জেলায় ৪১১টি গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারকে ঘরসহ জমির মালিকানা হস্তান্তর করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, খাজুরতলা প্রকল্পের আওতায় ২২ জন হিজড়া, ১০ জন ভিক্ষুক, ১৯ জন প্রতিবন্ধী, ২৮ জন বিধবা ও ৪১ জন হিন্দু পরিবারকে ঘর দেয়া হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ছোটখাটো কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শিশুরা যাতে শতভাগ শিক্ষা পায় তার জরিপ করা হচ্ছে। পাশাপাশি খাজুরতলায় অবশিষ্ট ১১ একর জমিতে আরো ১৫০টির বেশি ঘর নির্মাণ করা যাবে। তখন এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্প হবে। তিনি আরো বলেন, সাইক্লোন হলেও এই ধাপের ঘরের কিছু হবে না।

৩২৯০৪টি ঘর হস্তান্তর হবে আজ : আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প থেকে জানানো হয়েছে, এবার তৃতীয় ধাপে ৪৯২টি উপজেলার ৩২ হাজার ৯০৪টি অসহায় পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে বিনামূল্যে দুই শতক জমিসহ সেমি পাকা ঘর দেয়া হচ্ছে।

প্রকল্প সূত্রে আরো জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার ৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পরিবার প্রতি ৫ জন হিসেবে পুনর্বাসিত জনসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ২২০ জন। এর মধ্যে মুজিববর্ষের বিশেষ উপহার স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। এই ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীনের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা-২০২০ অনুমোদন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত গৃহের সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি। ৩য় পর্যায়ে ৬৫ হাজার ৪৭৪টির নির্মাণ কাজ চলমান। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৯০৪টি ঘর আজ উপকারভোগীদের কাছে হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App