×

মুক্তচিন্তা

‘নীরব দুর্ভিক্ষ’ চললে ৫ কোটি মানুষের ঈদযাত্রা, কেনাকাটা হয় কীভাবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:১৮ এএম

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ কিছুদিন থেকে বলে আসছেন যে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্য দেখে না বাস্তবে দুর্ভিক্ষ বা মঙ্গা দেখে তিনি এটি মনে করছেন তা বোঝা গেল না। দেশে দ্রব্যমূল্যের অবস্থা স্বাভাবিক নয়, এটি সরকারও স্বীকার করছে। তবে এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা বিশ্বেই অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে চলছে- এ কথা কারো অজানা নয়। দুই বছর অতিমারির কারণে অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লেনদেন বড় ধরনের পতনের মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবি শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য সংকটসহ নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের কথা বলে আসছে। তবে করোনাকালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। আমাদের জিডিপি ও প্রবৃদ্ধি অনেক দেশের চেয়ে ভালো ছিল এবং এখনো ভালো আছে। সে কারণে দুই বছর করোনার অতিমারিতে বাংলাদেশের মানুষ খাদ্য কিংবা চিকিৎসাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় পড়েনি। বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে বিনা পয়সায় সব মানুষকে টিকা প্রদানে সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে। অর্থনীতিতে বেহাল অবস্থায় থাকলে সরকার বিনামূল্যে এত মানুষকে টিকা প্রদান, করোনার চিকিৎসার আয়োজন, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারত না। কিন্তু‘ এসবই অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে করোনা সংক্রমণ কমে আসার পর দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বড়, মাঝারি ও ছোট প্রায় সবাই দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় যেন নেমে পড়েছিল। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ক্রমাগত তারা বাড়িয়েই চলছিল। এর মধ্যে তেলের দাম বৃদ্ধি করার অজুহাত দেখিয়ে, এমনকি সিএনজিচালিত যানবাহনও ভাড়া বৃদ্ধি ঘটিয়ে বসে। আমাদের বেশ কিছু করপোরেট সংস্থা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন এতটাই একচেটিয়া কারবারে পরিণত হয়েছে যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে ধান-চাল ব্যবসার সঙ্গেও তাদের অদৃশ্য সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সে কারণে খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। সরকার বাধ্য হয়ে টিসিবির মাধ্যমে কিছু পণ্য সাধারণ মানুষকে ক্রয়ের সুযোগ করে দেয়। এরই মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে অবরোধ, অস্ত্রব্যবসা, অর্থনৈতিক সংকট হঠাৎ প্রকট হয়ে ওঠে। এটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সব দেশেই পড়তে শুরু করে করেছে। এমন পরিস্থিতিতেও আমাদের দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যসামগ্রী নেই এমনটি কেউ দাবি করছে না। তবে আমদানিনির্ভর কিছু পণ্যের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে যেভাবে বাড়ছে তাতে আমাদের আমদানিকারক থেকে শুরু করে ছোট ছোট ব্যবসায়ী সবার মধ্যেই মজুতদারি, অতি মুনাফা করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এমনিতেই আমাদের বাজার জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দুই বছরের ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নেয়ার এক অনৈতিক কারসাজিতে পড়েছে। তার ওপর যুদ্ধ এবং উৎপাদন হ্রাসের বাস্তবতায়ও পড়ে যায়। বিশেষত ভোজ্যতেল, আটা-ময়দাসহ বেশকিছু পণ্যসামগ্রী আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিকভাবে ক্রিয়া করছে। এর প্রভাব এখানেও পড়েছে। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্যের মূল্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বেশ কষ্টের হয়ে ওঠে। কিছুদিন দেশের গণমাধ্যমগুলোতে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ওঠানামার খবর শীর্ষ খবরে পরিণত হয়েছিল। তখনই বিএনপি এবং বেশকিছু রাজনৈতিক দল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট হরতাল পালন করেছিল। বিএনপি সেই হরতাল সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু‘ সেই হরতাল ঢাকার যানজট ফেলে শাহবাগ বা জাতীয় প্রেস ক্লাবের বাইরে যেতে পারেনি। সেই সময়ই মির্জা ফখরুল সাহেব দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে বলে দাবি করছিলেন। দেশের মানুষ ভালো নেই বলেও তিনি ও তার দলের নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রচার করছিলেন। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষজন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হিমশিম খেয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে কারণে সরকার এক কোটি মানুষকে সাশ্রয়ীমূল্যে কিছু পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। তবে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মানুষদের কাছে এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে বলে হয়নি। নিম্ন মধ্যবিত্তরা কিছুটা হিমশিম খেয়েছে। তবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন শুধু শহরেই নয় গ্রামেও বেশ প্রসারিতভাবে গড়ে উঠেছে। নিম্নবিত্তের মানুষজন নানা ধরনের শারীরিক শ্রম, সরকারি নানা প্রণোদনা ইত্যাদির ফলে না খেয়ে থাকার অবস্থানে গেছে এমনটি কারো কাছে খবর ছিল কিনা আমাদের জানা নেই। কিন্তু দেশে এমন নীরব দুর্ভিক্ষ এমনটি কোথাও প্রচারণা বেশ আতঙ্ক ছড়াতেই কেবল ভূমিকা রাখতে পারে। দেশে কোনো সময়ই সব মানুষ সমানভাবে কেনাকাটা করতে পারেনি। বাজারমূল্যও সবার কাছে সহনীয় ছিল না। বিএনপির শাসনামলেও নয়। এখন অতিমারি এবং বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ধরে রাখা যাচ্ছে না। নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে মোটেও তা সহনীয় নয়। তবে নিম্নবিত্তরা নীরব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে এমনটি প্রমাণ করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। কেউ যদি উসকে দেন কিংবা দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ বলে আর্তনাদ করেন তাহলে সেটি সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্ব এবং দেশীয় এমন পরিস্থিতিতে এখন দেশে রোজা চলছে, আগামী সপ্তাহে ঈদ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলা নববর্ষের পার্বণ গেছে, রোজার শুরু থেকেই কেনাকাটা কমবেশি সবাই করছে, ব্যবাসায়ীরা দুই বছরের ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নিচ্ছে, বাজারে নানা ধরনের সিন্ডিকেট চলছে। তারপরও বাজারে কেনাকাটা থেমে নেই। এই ঈদে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা হয় কাপড়চোপড়, নানা প্রসাধনী, অলংকার, জুতা, স্যান্ডেল, শিশু-কিশোরদের দেয়ার মতো নানা ধরনের উপহার সামগ্রী। বাজারে এসবের কোনোটিই কি কেনায় কোনো কমতি আছে? লেহেঙ্গাসহ ভারতীয় নানা অভিজাতীয় পোশাক উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে, ইফতারের মুখরোচক খাবারও আগের মতোই বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চললে এসব কেনাকাটা চলছে কীভাবে? শোনা যাচ্ছে এবার ৫ কোটি মানুষ ঈদযাত্রায় ঘরমুখী হবেন। রেলের টিকেট কাটতে অসংখ্য মানুষ প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন। এক টিকেটের বিপরীতে ৭০০ জন ক্রেতার লড়াই করার কথা গণমাধ্যমে প্রচার করতে দেখছি। বাস, লঞ্চ, স্টিমার এখন থেকেই ঈদমুখী যাত্রী পরিবহন শুরু করেছে। ঢাকা শহর থেকে সোয়া এক কোটি মানুষ গ্রামে ঈদ করতে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দিয়ে টিকেট কিনতে হয়। নীরব দুর্ভিক্ষে কবলিত বাংলাদেশের মানুষ বলে যাদের দাবি করা হচ্ছে তারা কীভাবে এই বাড়তি ভাড়া দিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন? শুধু যাওয়াই তো শেষ কথা নয়, গ্রামে ঈদ উদযাপন উপলক্ষে বাড়িতে বাড়তি খরচও আছে। সেটিও তো তাদের খরচ করতে হবে। কয়েকদিন আগে ভোগ্যপণ্য ও দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে যে হাহাকার গণমাধ্যমের কল্যাণে শুনতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে তা এখন ঈদ পোশাক ও পণ্যসামগ্রী কেনাকাটায় কিংবা বাড়তি ভাড়া, ঈদ খরচ নিয়ে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বৈপরীত্যটা তাহলে কোথায়? এর কী কোনো জবাব আছে নাকি এখন তো সবাই কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত? এসব পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ঘটে থাকলে সেটি জানার বা বোঝার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি? ঈদ উপলক্ষে কত হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে সেটি কদিন পরেই জানা যাবে। ঈদ অর্থনীতি বলে একটি নতুন ধারণা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচারিত হচ্ছে। এ বছরও ঈদ অর্থনীতি থেমে নেই। বরং বলা হচ্ছে দুই বছর করোনার কারণে মানুষ স্বাধীনভাবে যাতায়াত বা চলাফেরা করতে পারেনি, ঈদও সেভাবে করতে পারেনি। এবার সে ‘ঘাটতি’ পুষিয়ে নিতে সবাই রংবেরঙের পোশাক, প্রসাধনী, জুতা, স্যান্ডেল, পছন্দের জিনিসপত্র কেনাকাটা করছে এবং ঈদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সামগ্রিক আবহটি নীরব দুর্ভিক্ষের কোনো প্রতিচ্ছবির বর্ণনা বা বহন করে কি? কোনো রাজনৈতিক নেতা হয়তো তারপরও বুঝাতে চেষ্টা করছেন যে দেশে মানুষ ভালো নেই। দেশের মানুষের জন্য তাদের ভালোবাসা হয়তো একটু বেশি, সে কারণেই তারা মানুষ ভালো নেই এই দাবি করে মানুষকে ভালো রাখার জন্য ঈদের পরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে মাঠে আন্দোলন নামাতে চাইছেন। দেশের মানুষ যদি তাতে সাড়া দেয় তাহলে আন্দোলন জমবে, তবে এর জন্য মানুষকে অভাবী কিংবা দুর্ভিক্ষ পীড়িত বলে আখ্যায়িত করার প্রয়োজন নেই। এটি বোধহয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও খুব একটা মেনে নেবে না, স্বীকারও করবে না। আমাদের দেশে এখন দুর্ভিক্ষ নীরবে বা সরবে কোনোভাবেই আসেনি বা বিরাজ করছে না। এটিই সত্য। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App