×

মুক্তচিন্তা

উপদেশ নয়, জাতীয় মানস গঠনে কাজ করুন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২২, ০১:২৫ এএম

‘নতুন প্রজন্মের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার ঘটাতে হবে’; ‘নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পথ চলতে হবে’; ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে’; ‘নতুন প্রজন্মকে ইস্পাত-কঠিন দেশপ্রেম নিয়ে বড় হতে হবে […]’ নতুন প্রজন্মকে কত কিছুই না করতে হবে! কিন্তু তারা কীভাবে করবেন এসব? কেনই বা করবেন, এসব করলে ‘ফায়দা’ই বা কী? উপদেশের পর উপদেশ দিলেও এ জাতীয় কোনো প্রশ্নেরই সমাধান-সূত্রের কথা কেউ কখনো উচ্চারণও করেন না! সবচেয়ে দুঃখজনক যারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে উপদেশের ফুলছড়ি ছড়ান তারা মন থেকে তা করেন কি-না সে প্রশ্নই সাম্প্রতিক নানা ঘটনাবলিতে প্রকট হয়ে উঠছে। উপদেশ মন থেকেই যদি তারা দিয়ে থাকতেন তবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রমের পরও একটি দেশে মৌলিক অন্তঃসারশূন্যতার বিষয়টি এতটা প্রকট হয়ে উঠত না। স্বাধীন একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর মৌলিক বিষয়-আশয়ে এত বিতর্ক সৃষ্টিরও অবকাশ তৈরি হতো না। জীবনযাপনের সর্বত্রই এখন নানামুখী বিতর্ক। বাঙালিত্বের আত্মগৌরব বিসর্জনের পথেই এই বিতর্ক মীমাংসা হবে কি-না সে সংশয়ও মনে জাগে। সংশয় জাগলেও তা সগৌরবে প্রকাশিত হয় না এটিই শঙ্কার কারণ। কালক্রমে সব বিতর্ক আত্তীকরণের মধ্য দিয়েই হয়তো বাঙালিত্বের অহংয়ের বিলুপ্তি ঘটবে- তদস্থলে অভিষিক্ত হবে ভিনদেশি রুচি ও সংস্কৃতি! রাজনৈতিক বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা এবং আওয়ামী আদর্শে উজ্জীবিত সরকারের বিভিন্ন ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন আমলারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওপরে বর্ণিত উপদেশমূলক বক্তৃতা দিয়ে আসছেন। কিন্তু কাজের কাজ আদৌ হচ্ছে কি-না তা দেখভালের যেমন কেউ নেই তেমনি সেসবের বাস্তবায়ন না হলেও কারো কোনো কিছু যায়-আসে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বক্তাদের যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য বড় বড় কথা বলা তেমনি শ্রোতাদেরও বিশেষ কর্তব্য হবে সেসব বক্তৃতা-ভাষণ শোনামাত্রই হজম করে ফেলা! এমন হজম যে তার আর কোনো রেশ-আবেশ বক্তৃতা সভার পর মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না! অর্থাৎ বড় বড় নেতাদের ততোধিক বড় বড় কথা এক কান দিয়ে ঢোকে এবং অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়! দেশের সর্বত্র উপদেশে সয়লাব হয়ে গেলেও উপদেশমূলক বক্তব্য-ভাষণের কোনো বাস্তবায়ন কোথাও নেই। নতুন প্রজন্মের মধ্যে তাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার নেই, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার প্রণোদনা নেই, ইস্পাত-কঠিন দেশপ্রেমের তো প্রশ্নই ওঠে না! সবচেয়ে গভীর ক্ষতের জায়গাটি হলো নতুন প্রজন্মের অনেকের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার চেয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদী মনোভাবই বেশি সক্রিয়! বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তরুণদের উদ্দেশে বড় বড় নেতাদের (?) নির্দেশনামূলক বক্তব্য তাই বড় বড় কথা ছাড়া আর কোনো পরিচয়ই বহন করে না। অর্থাৎ বড় বড় নেতাদের বড় বড় কথার বাস্তবায়ন কোথাও হয় না। কী করে হবে? আমরা কেউ বাস্তবায়নের কোনো দায়-দায়িত্ব নিই না, নিতে চাইও না। দায়িত্বশীলরাও স্ব-স্ব দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন! সবাই এই কথা ভেবে বসে থাকেন যে, বড় বড় কথা বলাই তার একমাত্র দায়িত্ব! কথাকে কাজে পরিণত করার দায়িত্ব যেন ভিনগ্রহের কারোর- অলৌকিক ভুবন থেকে কেউ এসে এসব কথার বাস্তবায়ন করে দিয়ে যাবে! বাস্তবত আমরা যেমন ভিনগ্রহের কারো সশরীরী অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি না তেমনি কোনো নেতার বড় বড় কোনো কথাকে কাজেও পরিণত হতে দেখি না। এ যেন অনেকটা ‘রাজার পুকুর দুধে ভরার’ সেই গল্পের মতো! দায়িত্ব এড়িয়ে এভাবেই ৫০টি বছর আমরা অতিক্রম করেছি। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্তরেই সামষ্টিক এবং ব্যাষ্টিক কিছু উন্নয়নও সাধিত হয়েছে। এই উন্নয়নকে মুখ্য ও মোক্ষম ভেবে জাতীয় মানস গঠনে আমরা যে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছি তারই ভয়ংকর রূপের স্পষ্ট আভাস সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় বিভিন্ন দিবস উদযাপনের আগে ও পরে সেই ভয়ংকর অপসংস্কৃতির রূপটিই আমাদের বারবার আক্রান্ত করছে! বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় বিভিন্ন দিবস নিয়ে নেতিবাচক বাহাসের মাত্রাতিরিক্ততা আমাদের ভয়ংকর সেসব প্রশ্নেরই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে! এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিগূঢ় বিষয়টি যেমন আছে তেমনি আছে ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসঙ্গও। একেবারে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছে মুক্তিযুদ্ধের কথাও। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গও বাদ দেয়া যাবে না। আমরা যে তিন-চারটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি তার সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা তরুণ প্রজন্মের কোনোরূপ নিবিড়-নৈকট্য আছে কি-না তা আবিষ্কার কঠিন! কারণ আমরা ফাঁকা মাঠে ফাঁপা বুলি আওড়িয়ে জনসভার পর জনসভা মাত করেছি ঠিকই; কিন্তু জাতীয় মানস গঠনে তরুণদের কাছাকাছি যাইনি কখনো, কোনোদিন। তরুণরা নিজেদের মতো নিজেরাই গড়ে উঠেছে! এ দেশে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় থাকায় জাতীয় মানস গঠনে দুই বিপরীতমুখী মনস্তত্ত্ব দীর্ঘদিন ধরেই তিল তিল করে দ্বা›িদ্বক অবস্থান সৃষ্টি করে আসছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমনির্ভর জাতীয় মানস গঠনে তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকটকে পুঁজি করে এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ী তাদের ‘ব্যবসায়’ও ফেঁদেছেন। তাদের লক্ষ বাঙালির নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা, ইতিহাসের পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এ জন্য ধর্মকে তারা কৌশলে ব্যবহার করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের ধর্ম-ব্যবসায়ের লাভের পরিমাণ আমাদের জাতীয় চেতনার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম এবং মাদ্রাসা মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় থাকায় এদেশে ত্রিবিধ মানস-রূপের প্রকাশ দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে বলেই সাধারণের মধ্যেও তার দ্বা›িদ্বক প্রকাশ আমরা সময়ে সময়ে উপলব্ধি করছি। এই দ্ব›দ্বই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় প্রতিটি দিবসে আমদের চরম বিতর্কের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। দ্বিমুখী এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট সম্পর্কে শৈশবে আমরা বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তির সমালোচনা শুনেছি। তখন ভাবতে পারিনি শিক্ষাগত রুচির কারণেই জাতীয় মানস গঠনে এতটা বৈপরীত্যের সৃষ্টি করবে! জাতীয় মানস গঠনের এই বৈপরীত্যের কারণেই ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের ঝড় ওঠে! একুশে ফেব্রুয়ারিসহ স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে শহীদ মিনার এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ নিয়ে বিরূপ সমালোচনা বাংলাদেশের মাটিতেই কী করুণভাবেই না সম্ভব হয়ে ওঠে! কেনই বা সম্ভব হবে না? এ দেশেই তো সপরিবারে নিহত হয়েছেন বাঙালির স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! এ তো সেই ‘সব সম্ভবের দেশ’! তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার ঘটাতে হবে এ কথা বলা খুবই সহজ। কিন্তু সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিস্তারের কৌশলপত্র সম্পর্কে যিনি কেবল বক্তৃতাই দিয়ে যাচ্ছেন তারও ধারণা আছে কি-না জানি না। তবে তরুণ বা নতুন প্রজন্মের সামনে সেই ধারণাপত্র যে নেই তা বলাবাহুল্য মাত্র। তেমনি একই কথা খাটে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় তরুণদের উজ্জীবিত হওয়ার প্রশ্নেও। বিশাল জনসভা, গুরুগম্ভীর সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামে দাঁড়িয়ে তরুণ প্রজন্মকে বলে দেয়া হলো তোমরা বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উজ্জীবিত হও আর সঙ্গে সঙ্গে তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনাকে বক্ষে ধারণ করে ফেলল; বিষয়টি যদি সে রকমই সহজ হতো তাহলে কোনো কথাই ছিল না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের অন্তহীন অনুশীলন। কিন্তু সে রকম নিরবচ্ছিন্ন সময় কে কাকে দিয়েছে তাও জানি না। উপরন্তু এসবের জন্য যে প্রেরণা ও প্রণোদনার পটভূমি দরকার তরুণ সমাজকে আমরা তা কখনোই কি দিতে পেরেছি? আমাদের মনে হয় তথাকথিত বড় বড় নেতারা তা আন্তরিকতার সঙ্গে মন থেকেও প্রত্যাশা করেননি। যদি তাই করতেন তাহলে আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি জাতীয় মানসের গর্বিত অবয়ব প্রত্যক্ষ সম্ভব হতো। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি যারা কেবল প্রকাশ্যে গালভরা উপদেশ দিয়েই নেপথ্যে চলে যান- তারা সমগ্র জনপদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। আপনাদের এই দেশ কিন্তু ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কার ও সাংস্কৃতিক চেতনায় আর আগের মতো নেই! ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। প্রায় সবই আপনাদের বেহাত হয়ে গেছে- বেহাত হয়ে গেছে আপনাদের স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং দেশপ্রেম! বেহাত হয়ে গেছে বাঙালির শাশ্বত সাংস্কৃতিক মনোজগৎও। আপনাদেরই যৌবনের দেশপ্রেম নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে বাঙালির শাশ্বত স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনুন। তাদের মানস গঠনের কাণ্ডারি হোন। অন্তঃসারশূন্য উপদেশ বিতরণ করে করে আর সময় নষ্ট করবেন না। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App