×

জাতীয়

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ৯ বছরে কতটা এগুলো কর্মপরিবেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২২, ১০:৪২ পিএম

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা। সাভারের নয়তলা ভবন রানা প্লাজার পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা দল বেঁধে প্রবেশ করছেন। যে যার মতো করে কাজে যোগ দিচ্ছেন। তখনো তারা জানতেন না- কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল এ ভবনটি ধসে পড়ে। হাজারখানেক শ্রমিক প্রাণ হারায় ঘটনাস্থলেই। ভবনে আটকে পড়া ও হাসপাতালে মারা যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১১৩৬ জনে। ঘটনায় আহত হন আরো কয়েক হাজার শ্রমিক। দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। দীর্ঘ ৯ বছরেও বিচার শেষ হয়নি রানা প্লাজার ভবন ধসের মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার।

ঘটনার আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটলের কথা শুনলেও খুব একটা পাত্তা দেননি রূপালি আক্তার। ছুটির পরে কারখানা বন্ধ থাকলে কয়েকজন মিলে নবীনগরে ঘুরতে যাবেন ভাবনা নিয়ে পরদিন সাড়ে ৭টার দিকে নতুন জামা পরে মজিদপুরের বাসা থেকে কারখানায় যান তিনি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঝুঁকির মধ্যেও রানা প্লাজার সপ্তম তলার নিউওয়েব বটমস লিমিটেডের হেলপার রুপালি আক্তার কাজ শুরু করেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। ভবনধসে অন্য অনেক সহকর্মীর সঙ্গে চাপা পড়েন তিনি। ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা ছাদ কেটে অন্যদের সঙ্গে তাকেও উদ্ধার করেন। এ দীর্ঘ সময় রুপালি আক্তার তারই সহকর্মী তানজীলার মৃতদেহের ওপর শুয়েছিলেন। দীর্ঘসময় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে থাকায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। দেড় বছর চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হন।

ঢাকার কাছে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার কারণ হিসেবে সে সময় মোট ৯টি কারণের কথা উল্লেখ করে গার্মেন্ট মালিকদের সমিতি বিজিএমইএ। সংগঠনটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নকশাবহিভর্‚তভাবে ভবন নির্মাণ, নিচু মানের সামগ্রী ব্যবহারই ছিল রানা প্লাজা ধসের প্রধান কারণ। এছাড়া ভবনের নিচু মানের পিলার, ফ্লোরে জেনারেটর স্থাপন, বয়লার আর ভারী মেশিন বসানো, অতিরিক্ত কাঁচামাল আর ধারণ ক্ষমতার বেশি কর্মী থাকা -ভবন ধসের জন্য দায়ী।

রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কাজ শুরু করে। কিন্তু ৯ বছরে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে? অধিদপ্তরের সেফটি শাখার কর্মকর্তাদের মতে, কাজ হচ্ছে। কিন্তু এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছানো যায়নি। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে অনেক জনশক্তির দরকার বলে মনে করেন তারা।

এই দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা যেমন যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি, তেমনি যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে অনেক শ্রমিক ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। তাই হতাহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের ফাঁসির দাবিতে প্রতি বছরই এই দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে পাঁচ বছরের জন্য ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। তারা দুই হাজারের বেশি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে বিভিন্ন ধরনের ত্রæটি চিহ্নিত করে। আর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বাইরে থাকা কারখানাকে সংস্কারকাজের আওতায় আনতে এনটিএপির অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) পরিদর্শন কাজ করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বে ও ডিআইএফইর তত্ত¡াবধানে গঠিত সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি) কারখানাগুলোর দেখভাল করছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশে ক্ষতিপূরণের আইন একটি তামাশা। শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন হলো না। এখন পর্যন্ত বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের নেত্রী তাসলিমা আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের এ বছরের স্লোগান হচ্ছে- মৃতদের স্মরণ করো, জীবিতদের জন্য লড়াই কর। আমরা অনেকদিন থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু শ্রম আইনের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সেটা দিয়ে নিহতের পরিবার বা আহতদের যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, তা এক ধরনের সহযোগিতা মাত্র।

তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে শ্রমিকের নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়গুলো সামনে আসে। আমাদের ধারণা ছিল শ্রমিকদের জীবনের অনেক পরিবর্তন হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভবনগুলোর কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবে ক্ষতিপূরণের আইনে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। দোষীদের শাস্তির আওতায় না আনার কারণে সার্বিক কোনো উন্নতি হয়নি বললেই চলে। আমরা মনে করি, যারা মারা গিয়েছেন তারা খুব কম মজুরি পেতেন। এখন যারা আমরা বেঁচে আছি তারাও এই উচ্চমূল্যের বাজারে খুব কম বেতন পাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App