×

রাজধানী

রাজধানীর যেখানেই ফুটপাত সেখানেই চাঁদাবাজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২২, ০৯:২৮ এএম

রাজধানীর যেখানেই ফুটপাত সেখানেই চাঁদাবাজ

রাজধানীর একটি ফুটপাতের দৃশ্য

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের পর আবার আলোচনায় ফুটপাতে চাঁদাবাজি। শুরুতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও পরে বাড়াবাড়ির জন্য ছাত্ররা ফুটপাতের চাঁদাবাজিকে দায়ী করেছেন। আর একজন হকার নেতা বলেছেন, “যেখানে ফুটপাত আছে সেখানেই হকার আছে আর সেখানেই চাঁদা আছে, চাঁদাবাজ আছে, লাইনম্যান আছে।”

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স এন্ড ডেভেলমেন্ট ২০১৬ সালে ‘দ্য স্টেট অব সিটিজ ২০১৬: ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা সিটি-গভর্নেন্স পারসপেক্টিভ' শিরোনামে এক গবেষণায় বলে যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। যা ওই সময়ে দুই সিটি কর্পোরেশনের মোট বাজেটের চেয়ে বেশি ছিলো। আর প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় ৬০ কোটি টাকারও বেশি। খবর ডয়েচে ভেলের।

ওই গবেষণায় ঢাকায় তখন মোট হকারের সংখ্যা বলা হয় তিন লাখ। আর প্রতি হকারের কাছ থেকে গড়ে তখন প্রতিদিন ১৯২ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। ওই গবেষক দলের প্রধান ছিলেন ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। তিনি এখন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্ট্যাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি জানান, “হকারদের সংখ্যা আমরা সংবাদ মাধ্যম থেকে নিয়ে পরে যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছি। আর চাঁদার পরিমাণ জেনেছি সরেজমিন কাজ করে। আমরা হকারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছি।”

তিনি বলেন, “আমাদের টার্গেট ছিল ফুটপাতের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা। দেখলাম এর একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। এই চাঁদা রাজনৈতিক লোকজন, পুলিশ ও লাইনম্যানেরা নেয়। লাইনম্যানেরা আবার পুলিশের নিয়োগ করা। আমরা প্রস্তাব করেছিলাম যে সিটি কর্পোরেশন যদি এটা রেগুলারাইজ করে ট্যাক্স হিসেবে নেয় তাহলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে এবং সরকারের আয় হবে।”

ওই গবেষণায় বলা হয় ফুটপাতে চার বর্গফুট জায়গার জন্য মাসে তিন হাজার টাকা চাঁদা নেয়া হয়। আর প্রতিটি লাইটের জন্য প্রত্যেকদিন নেয়া হয় ২৫ টাকা করে। মাসে দুই হাজার টাকা। এই গবেষক বলেন নতুন করে কোনো গবেষণা না হলেও পর্যবেক্ষণ বলছে এখন হকার বেড়েছে। চাঁদার আকারও বেড়েছে। আর আগের অবস্থাই বহাল আছে। পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা এবং লাইনম্যানেরাই এখনো ফুটপাতের চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করে।

হকার লীগের সভাপতি আবুল কাসেম জানান, “এখন ঢাকা শহরে সাড়ে তিন লাখ হকার আছেন। তাদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন প্রতিদিন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাাজার টাকা নেয়া হয়। এটা এলাকা এবং আকারের ওপর নির্ভর করে। গড়ে কমপক্ষে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় হয় প্রতিদিন প্রতিজন হকারের কাছ থেকে। আর ঈদের আগের একমাস এই রেট বেড়ে যায়।”

তার হিসাব সঠিক ধরে নিলে ঢাকায় প্রতিদিন এখন হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হয় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বছরে তিন হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। তিনি জানান, ঢাকার নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় মোট পাঁচ হাজার হকার আছে। এখান থেকে প্রতিদিন চাঁদা আসে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা। তাই এখানে একদিন দোকান বা ফুটপাথ বন্ধ থাকলে যারা এই চাঁদা নেন তাদের বিরাট ক্ষতি।

এই চাঁদা কারা নেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কতিপয় পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনের লোক এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের কিছু রাজনৈতিক নেতা। আর এই টাকা তোলার জন্য লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার আছে।” তার কথা, “লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার ঠিক করে দেয় পুলিশ। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের পরিবর্তন হয়না। তাদের কাজ সরকারি চাকরির মত।”

জানা গেছে একজন লাইনম্যানের অধীনে একটি করে ‘ফুট' থাকে। একটি ফুটে সার্বোচ্চ ৩০০ হকার বসতে পারেন। তাদের একটি করে চৌকির জায়গা (দুই হাত বাই চার হাত) বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে ফুটপাত ছাড়াও সরসরি রাস্তায়ও হকারদের বসতে দেয়া হয়। আর আছে ভ্রাম্যমাণ বরাদ্দ।

হকার নেতা মুরশিকল ইসলাম বলেন, “এটার বড় সুবিধাভোগী হলো প্রশাসন। তারাই তাদের লাভের জন্য চাঁদার বিনিময়ে এই ফুটপাত ভাড়া দেয়া টিকিয়ে রেখেছে। তবে প্রশাসনের কারা এটা সবাই জানে। সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই না। বললে হকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”

আবুল কাসেম বলেন, “ঢাকা শহরে যেখানেই ফুটপাত আছে সেখানেই ফুটপাতে দোকান আছে, চাঁদা আছে। চাঁদাবাজ আছে। কতিপয় পুলিশ এটার মূল নিয়ন্ত্রক। তাই এটা বন্ধ করা সহজ নয়। ফুটপাত থাকলে চাঁদাবাজিও থাকবে।”

তার কথা, “নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশের ব্যবসায়ীদের পক্ষ নেয়া এবং সঠিক সময়ে পুলিশ না যাওয়ার পিছনে আছে এই ফুটপাতের চাঁদা। কারণ ফুটপাতের দেকান একদিন বন্ধ থকলে যারা চাঁদা দেন তাদের অনেক ক্ষতি। ঈদের আগে তো আরো বেশি ক্ষতি।”

আর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ফুয়াদ হাসান অভিযোগ করেন, “শুধু ফুটাপাত নয়, স্থায়ী দোকানদারদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। আর সে কারণেই ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ করেছে পুলিশ।” তবে একজন ব্যবসায়ী বলেন, “আমাদের কাছ থেকে সরাসরি চাঁদা নেয়না। আমরা মালিক সমিতির মাধ্যমে নিরাপত্তার জন্য মাসিক ভিত্তিতে একটা খরচ দেই।”

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও ডিএমপির রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ হোসেনকে পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাংলাদেশ পুলিশ মেনে চলে। আমাদের বর্তমান আইজিপি মহোদয় দায়িত্ব নেয়ার পর পাঁচটি মূলনীতি ঘোষণা করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, বিট পুলিশিং, মানবিক কার্যক্রম এবং ওফেলফেয়ার পুলিশিং নিশ্চিত করা। ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা বা যেকোনো রকম চাঁদাবাজি স্পষ্টতই একটি দুর্নীতি এবং গর্হিত অপরাধ। এ ধরনের কোনো অপরাধের প্রমাণ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নেই। এখানে কোনো ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই।”

তিনি জানান, “যারা অভিযোগ করেন তারা যদি প্রমাণ ও তথ্য উপাত্তসহ অভিযোগ করেন তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। দোষ প্রমাণ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই প্রক্রিয়া চলমান আছে।”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App