×

জাতীয়

নিউমার্কেটের সংঘর্ষে কারা এই তৃতীয় পক্ষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২২, ০৮:২১ এএম

নিউমার্কেটের সংঘর্ষে কারা এই তৃতীয় পক্ষ

ফাইল ছবি

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় তৃতীয় পক্ষ ছিল বলে দাবি উঠেছে। ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী উভয় পক্ষের অভিন্ন দাবি ওঠায় পুলিশ ও গোয়েন্দারা খোঁজখবর শুরু করেছে। সংঘর্ষের দীর্ঘসূত্রতা এবং পাল্টাপাল্টি বিপুল সংখ্যক ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় এর উৎস খোঁজা হচ্ছে। বিশেষ করে, টানা দুই দিনের বেশি সময় বিরামহীন সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কারা উত্তাপ ছড়িয়েছে, তা চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এর মধ্যে নানা বয়সি কয়েক’শ লোক হেলমেট পরে সংঘাতে জড়ালে তাদের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় কতটুকু রাজনৈতিক ইন্ধন কাজ করেছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ঢাকা নিউমার্কেটের দুই ফাস্টফুড দোকানের কর্মচারীদের বাকবিতণ্ডা থেকে সূত্রপাত হওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রভাব মুহূর্তেই কীভাবে বিরাট এলাকার কমপক্ষে ২২টি মার্কেটে ছড়িয়ে পড়েছে, তার কারণ অনুসন্ধান করছেন গোয়েন্দারা। ছাত্র-ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘাত বাধিয়ে কে কী ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছিল, তার কারণ খুঁজছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দিন রাতে সংঘর্ষের পরের দিন মঙ্গলবার সকালে বিনা উসকানিতে ঢাকা কলেজে হামলা, মার্কেট বন্ধ ঘোষণার পরেও ব্যবসায়ী-কর্মচারীসহ শত শত লোকের সমবেত হওয়া, ১২ সাংবাদিককে মারাত্মকভাবে জখম করা, অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করার ঘটনাগুলো তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতির দাবি আরো জোরদার করেছে। এমনকি ব্যবসায়ী নেতারাও বলছেন, সাংবাদিকদের ওপর ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলা কোনো ছাত্র বা ব্যবসায়ীর কাজ হতে পারে না। এখানে তৃতীয় পক্ষ থাকতে পারে। ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষও সংঘর্ষের পেছনে উসকানির কথা বলেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, এই তৃতীয় পক্ষ কারা? কার নির্দেশে তারা হামলায় অংশ নিয়েছে? এসব বিষয়ে জানতে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। অতি উৎসাহী হামলাকারীদের পরিচয় নিশ্চিত হতে কমপক্ষে ১০ জন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা কলেজের বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। ফুটেজ দেখে কয়েকজন সহিংস হকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পাশাপাশি নিউমার্কেটে ফাস্টফুডের ঘটনায় মারধরের শিকার হওয়ার পর ক্যাম্পাসে ফিরে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে উত্তাপ সৃষ্টি করা তিন ছাত্রকেও চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তারা হলেন ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের নাসিম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লিটন ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের আবদুল্লাহ আল মাসউদ। তারা তিনজনই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী।

নিউমার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী নিশ্চিত করেছেন, গত সোমবার ইফতারের সময় টেবিল পাতা নিয়ে নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেটের ওয়েলকাম ফাস্টফুডের কর্মচারী বাপ্পীর সঙ্গে অন্য ফাস্টফুড দোকান ক্যাপিটালের কর্মচারী কাওসারের বাকবিতণ্ডা হয়। এর জেরে বাপ্পী ও তার সহকর্মী সজীবের ডাকে ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের শায়েস্তা করতে ছুটে আসেন তারা। তাদের নেতৃত্বে ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীরা নিজেদের দোকানের ছুরি, চাকু নিয়ে পাল্টা হামলা চালান। এরপর আহত হয়ে পালিয়ে যায় ঢাকা কলেজ থেকে আসা দলটি। তবে তারা পরে কলেজের আরো ছাত্রদের নিয়ে এসে নিউ মার্কেটে ফের হামলা চালায়। ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মী কাওসার ও ওয়েলকাম ফাস্টফুডের কর্মী বাপ্পীর বাসা রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায়। তবে ঘটনার পর থেকে তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, দুজনের মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।

এদিকে গতকাল দুপুরে নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত বড় ঘটনার পেছনে নিশ্চিত কোনো তৃতীয় পক্ষ রয়েছে। কেননা সংঘর্ষ চলাকালে অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণ এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাটিও অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। কোনো ব্যবসায়ী বা ছাত্র এ কাজ করতে পারে না। এ ঘটনায় স্পষ্ট প্রতীয়মান এখানে তৃতীয়পক্ষ জড়িত। জানি না তারা কারা?

তিনি আরো বলেন, তারা উচ্ছৃঙ্খল জনতা, এখানে তৃতীয় পক্ষ ছিল, নিশ্চিত করে বলছি। তবে এ ঘটনায় যদি কোনো ব্যবসায়ী জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাংবাদিকদের ওপর দোকান মালিক-কর্মচারীদের হামলার বিষয়ে পদক্ষেপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর্মচারীরা তেমন লেখাপড়া জানে না। তারা যদি কোনো খারাপ আচরণ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার রাতে সংঘর্ষের পর আমরা আমাদের ছাত্রদের বুঝিয়ে নিয়ে আসি এবং ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে মঙ্গলবার সকালে মার্কেটের লোকজন এসে আক্রমণ চালায় এবং ঢাকা কলেজের ভেতরেও ঢুকে যায়। এরপরেই সমস্যাটি হয়। আর এবার যে ঝামেলা হয়েছে, সেটি তো পুরোটাই নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বিষয় থেকে শুরু। এখানে ছাত্ররা জড়িত ছিল না, জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার রাতে সংঘর্ষ হওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকেই নিউমার্কেট এলাকায় জড়ো হন শত শত ব্যবসায়ী-হকার ও কর্মচারী। তারা অতর্কিতে ঢাকা কলেজে হামলার পর ব্যাপক পরিসরে সংঘর্ষ শুরু হয়। ঘটনাস্থলে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম থাকলেও অতি উৎসাহী কিছু লোক সামনে থেকে হামলায় অংশ নেয়। তারা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারীদের সংঘর্ষে অংশ নিতে আহ্বানও জানায়। অনেক কর্মচারী তাণ্ডবে অংশ না নিয়ে ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এরই মাঝে একদল লোক হেলমেট পড়ে তাণ্ডবে অংশ নেয়। কিন্তু এই লোকগুলো কি উদ্দেশ্যে এত উৎসাহ দেখাল, সাংবাদিকদের ওপর হামলা করল সে বিষয়ে কেউ কোনো তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি।

এদিকে বিরতিহীন সংঘর্ষের আঁচ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লেও পরিস্থিতি নিরসনে স্থানীয় সাংসদ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের দেখা পাননি কেউ। তিনি নিজেও একজন বড় ধরনের ব্যবসায়ী। তার এ নীরবতায় জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে।

ডিএমপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়াদের বেশির ভাগই দোকান কর্মচারী ও ফুটপাতের হকার। বিনা উসকানিতে কেউ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে কিনা সে বিষয়েও তদন্ত চলছে। নিউমার্কেট থানা ছাড়াও ডিএমপির নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট, মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও সাইবার টিম ঘটনা তদন্তে কাজ করছে। মিথ্যা তথ্য প্রচার করে কেউ পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে কিনা তা শনাক্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো স্ক্রিনিং করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ বেশ কয়েকজন সহিংস হকারকে চিহ্নিত করেছে। একাধিক ফুটেজে ঘুরেফিরে তাদের চেহারা দেখা গেছে। সাংবাদিকদের ওপর ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও পথচারীকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ ভোরের কাগজকে বলেন, ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের কাছ থেকে তৃতীয়পক্ষের কথা আমরাও শুনেছি। ঘটনাস্থল থেকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অতি উৎসাহী বেশ কয়েকজন হামলাকারীকে আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদের পরিচয় শনাক্তের কাজ চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা হেলমেট পরিহিত ছিল, তারা শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ এখন অনেক শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীর মোটরসাইকেল রয়েছে। সংঘর্ষ শুরুর পরে উভয়পক্ষের অনেককেই আমরা মোটরসাইকেল থেকে হেলমেট নিয়ে পরতে দেখেছি।

ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ঘটনাটি আমরা তদন্ত করছি। এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হবে। মামলায় ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিউমার্কেট থানা সূত্রে জানা গেছে, মামলায় ডেলিভারিম্যান নাহিদকে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদির ধারা যুক্ত করা হবে।

উল্লেখ্য, গত সোমবার রাত ১২টার দিকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। মঙ্গলবার সকালে আবারও সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীরা। মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। ছাত্রদের অনেকে হেলমেট পরে এবং লাঠি হাতে সংঘর্ষে জড়ান।

ব্যবসায়ী-কর্মচারীরাও লাঠিসোটা ও লোহার রড নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো শুরু করেন। থেমে থেমে চলা এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ১২ সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হওয়া কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেন মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিকেলে মারা যান। সংঘর্ষের এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App