×

জাতীয়

চ্যালেঞ্জে ভারসাম্যের কূটনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০৮:৩৩ এএম

চ্যালেঞ্জে ভারসাম্যের কূটনীতি

ফাইল ছবি

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দুই পরাশক্তির চাপ, কোয়াড-আইপিএসে যোগ দিতে মার্কিন তাগিদ, চীনের মানা

গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কথা মতো না চলা, কোয়াডে যোগ দিতে চীনের বাধা এবং বাংলাদেশে চীনের ‘মাত্রাতিরিক্ত’ তৎপরতায় ভারতের উদ্বেগ নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারসাম্যের কূটনীতি বহাল রাখতে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির ‘উদ্ভব’ হয়। সেক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্য থেকে বাংলাদেশ নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবে- এটাই এখন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে এটা প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হবে।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ালিউর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ভারসাম্যের কূটনীতিতে সমস্যা আছে, মতপার্থক্যও দেখা দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছে। এখন পরিস্থিতি যে জায়গায়ই যাক না কেন, আমেরিকার যেমন বাংলাদেশকে দরকার, তেমনি বাংলাদেশেরও আমেরিকাকে দরকার আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধই কিন্তু পরিস্থিতির মেরুকরণ ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিমত তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশের ক্ষোভের কারণে সেই অবস্থান থেকে সরে আসবে না বাংলাদেশ- এই বার্তাটি পরিষ্কার করার পর চাপ আরো বাড়ছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ধর্মীয়বিষয়ক বিশেষ দূত রাশাদ হোসাইন ঢাকা সফরে এসে গতকাল হিন্দু নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। হঠাৎ করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কেন সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে- এ নিয়েও নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। এই সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত। তাহলে কী আওয়ামী লীগের ওপর চাপ বাড়াতেই এই কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র?

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম ভোরের কাগজকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, তারা বাংলাদেশকে ‘গরম-ঠাণ্ডা’ মিশিয়ে দুধরনের বার্তা দিতে চায়। এই বার্তাগুলো বাইরে থেকে বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, এটা চাপের একটি প্রক্রিয়া। এখন এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল। কারণ গত মাস ছয়েক ধরেই এর ধারাবাহিকতা চলছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্টের ধর্মীয়বিষয়ক দূত বাংলাদেশে হিন্দু নেতাদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন তাও মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপেরই একটি ইঙ্গিত।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনটি গত মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও হত্যা-গুমের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়ার সংবাদ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা জানানো হয়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে, সেই নির্বাচন নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর আগে ওয়াশিংটন-ঢাকা নিরাপত্তা সংলাপ, দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানেও এসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকার খুশি নয়। সব মিলিয়ে চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো পরাশক্তিগুলোর মেরুকরণে ভারসাম্য বজায় রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো একপক্ষ নিলেও হয় না; আবার নিরপেক্ষ থাকারও সুযোগ কম। সংশ্লিষ্টরা জাতিসংঘে ইউক্রেনের ওপর ভোটাভুটির উদাহরণ টেনে বলছেন, এটা এমন একটা কঠিন পরিস্থিতি, ভোট দিলেও বিপদ না দিলেও বিপদ। হয়েছেও তাই। প্রথমে ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।

তখন এক ধরনের সমস্যা হলো। তারপর দ্বিতীয়বার যখন ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিল তখনো রাশিয়ার সঙ্গে একটা টানাপড়েনের আশঙ্কা তৈরি হলো। পরাশক্তিগুলোর ‘নিজের পক্ষে টানার কূটনীতি’ দিনে দিনে মারাত্মক আকার ধারণ করছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সদ্য সাবেক হওয়া প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রকাশ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শোনায় তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা বয়ে আনছে- প্রশ্নটিও নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করছে।

এসব বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল রবিবার নিজ দপ্তরে বলেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাক গলানো আশা করে না সরকার। গত এক দশকে বাংলাদেশ শ্রম খাতসহ আরো অনেক খাতে এগিয়েছে। তবুও এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কথা বলতে আসে। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে সরকারের দায়মুক্তি দেয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তাকে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে অনেক মৌলিক তথ্যে ‘ভুল’ রয়েছে দাবি করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াশিংটনের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে বাংলাদেশ সরকার। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনে আরো কিছু বৈঠক রয়েছে। সে বৈঠকগুলো এগিয়ে নিতে প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে গঠনমূলক জায়গায় যেতে চায় বাংলাদেশ।

এদিকে কোয়াড মূলত একটি সামরিক জোট। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান- এই ৪টি দেশ মিলে সামরিক জোট গঠন করেছে। যদিও সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয় না যে এটি সামরিক জোট। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর এখন কোয়াডকে এশিয়ার ন্যাটো হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। আইপিএস হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলবিষয়ক কৌশল (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সংক্ষেপে আইপিএস)। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে আইপিএসে যোগ দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো যোগ দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ নেতারা ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশকে কোয়াড-আইপিএসে যোগ দিতে। ইইউর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিশেষ দূত গ্যাব্রিয়েল ভিসেন্টিন সম্প্রতি ঢাকায় এসে আইপিএসে যোগ দিতে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন। গত মাসে বাংলাদেশ সফর করা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডও একই আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশকে। তিনি বলেছেন, হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দায়িত্ব নেয়ার পরই আইপিএসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে কাজ করতে পারে সেই রূপরেখা দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ যেন এই জোটে যোগ না দেয় সেই চাপও দিয়ে যাচ্ছে চীন। বাংলাদেশ কোয়াড-আইপিসে যোগ দিচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পর গত বছর তো ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ যদি কোয়াডে যোগ দেয় তাহলে চড়া মূল্য দিতে হবে।

চীনের এমন হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন কোয়াড বা আইপিএসে যোগ দেয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চীন প্রকাশ্যে এমন কথা না বলে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলেই পারত। এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘স্প্রিং ডায়লগ উইথ চায়না’ শীর্ষক ব্রিফিংয়ে লি জিমিং আবার সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কোয়াডে যোগ দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করে চীন। এছাড়া বাংলাদেশে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র করার খবরে উদ্বিগ্ন রয়েছে ভারত। জাপানের ‘নিক্কেই এশিয়া’ সাময়িকীতে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লির উদ্বেগের বড় জায়গা হলো বাংলাদেশের মতো ভারতের পুরনো মিত্রদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করে চীন ওই সব দেশের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলছে। এটাকে ‘বাড়াবাড়ি’ মনে করছে নয়াদিল্লি। যদিও ‘স্প্রিং ডায়লগ উইথ চায়না’ অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে বেইজিংকে চিঠি লিখবেন বলে জানান। লি জিমিং বলেন, বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সামরিক কোনো সরাঞ্জম তৈরির কাজ করে না চীন। তবে কোনো দেশ চাইলে সামরিক সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণে সহযোগিতা করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App