×

সাহিত্য

মৌলবাদ ঠেকাতে হবে শিল্পের স্পন্দন ছড়িয়ে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১১:২০ পিএম

মৌলবাদ ঠেকাতে হবে শিল্পের স্পন্দন ছড়িয়ে

ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেছেন, এবারের বৈশাখী আয়োজনে প্রাণের স্পন্দন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পাচ্ছি। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে যে রকমটা পাই, সে রকম না। এর কারণ দুটো- আমাদের অনেক জানাশোনা লোকজন যারা আছেন, যারা দূরদূরান্ত থেকে আসতেন, তারা আসতে পারেন না। শুধু রোজার জন্য নয়, ট্র্যাফিক জ্যাম এবং গরমও একটি কারণ। সব মিলিয়ে খুব যে লোক সমাগম হয়েছে, তা নয়। হয়তো আরো লোকজন আসবে।

অন্যদিকে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের গত দুই বছর যে পরীক্ষা হয়নি, সেই পরীক্ষাগুলো চলছে। পাশাপাশি তারা কাজও করছে। আবার এদেরই একটা অংশ রোজাও রাখছে। যে কারণে আমাদের সব কিছু সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। যেন সবার উপরে চাপটা কম পড়ে। কাজটা আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে। এছাড়া আমাদের সময়টাও এবার কম। মাত্র ১৩ দিনের প্রস্তুতিতে কাজ শুরু করেছি। আগে এক মাসের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেছি। বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন সম্পর্কে গতকাল বুধবার ভোরের কাগজকে তিনি এসব কথা বলেন।

অন্য বছরের তুলনায় এবারের আয়োজন অনেক সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আমরা ২০২১ সালে যে মঙ্গল শোভাযাত্রার যে প্রতীকী আয়োজন করেছিলাম, তার থেকে অনেক অনেক বড় এবারের আয়োজন। কিন্তু ২০১৯ ও ২০১৮ সালের তুলনায় কিছুটা কম।

এবারের আয়োজনে নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রার নির্দিষ্ট ধরন আছেই। আমরা লোকশিল্প থেকে যে সমস্ত পুতুল কিংবা খেলনা নিয়ে বড় করি, সেগুলো সেভাবেই বড় হবে। শুধু মোটিফগুলো নেয়ার সময় আমাদের চিন্তা করতে হয়, আমাদের যে প্রতিপাদ্য থাকে, সেই প্রতিপাদ্যের সঙ্গে যেন সম্পর্ক থাকে। যেমন গত বছর আমরা মানুষকে সিগনাল দিয়েছিলাম, আমরা যেসব রাজা-রানী বানিয়েছিলাম, সবগুলোকে মাস্ক পরিয়ে দিয়েছিলাম। মুখোশের পরিবর্তে ফেসশিল্ডের ছবি এঁকে সেসবকে মাস্কের মতো বানিয়ে ছিলাম। যেহেতু তখনো কোভিড চলছিল এবং মারাত্মক অবস্থায় ছিল। আমরা এর মধ্য দিয়ে একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এবার করোনা থেকে যখন মুক্ত হয়েছি, এই মুক্তির একটা প্রতীক হিসেবে এ বছর করেছি তিনটা পাখি, সেই তিনটা পাখি থেকে একটা পাখি ডানা মেলে উপরে উড়ে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে মুক্তির প্রতীক। আমরা যে করোনা থেকে মুক্তি পেয়েছি, এর প্রতীকী রূপ এটা। আর আগামী দিনকে বরণ করে নেয়া। যেখানে আমরা কামনা করছি ‘নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’। করোনা থেকে মুক্তি পেয়ে আগামী দিনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এর প্রতীক হিসেবে একটি বড় মাটির টেপা পুতুল নেয়া হয়েছে। এর যে পোড়া মাটির রং তা করা হয়েছে সাদা এবং তার গায়ে কিছু রঙিন নকশা থাকছে, হাতে থাকবে বরণমালা। এ রকম দুটো মোটিফ এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার নতুনত্ব। এগুলোর কোনো আলাদা নাম নেই।

দেশে মৌলবাদের আস্ফালন আগের চেয়ে বহু গুণ বেড়েছে। এ সম্পর্কে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মৌলবাদের আস্ফালনকে প্রতিরোধ বা মোকাবেলা করতে আমাদের শিল্পীদের উপায়টা শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হবে। তারা আস্ফালন আর আমরা আমাদের কাজ আরো জোরালোভাবে করব, এটাই আমাদের প্রতিবাদ। আমরা তো তাদের মতো আচরণ করতে পারি না। আমাদের প্রক্রিয়াটাই ভিন্ন। আমরা যে কাজগুলো করছি এবং করতে পারছি, এটাই আমাদের প্রতিবাদ। তারা তো সারা বছর ধরে আস্ফালন করে। আমরা বছরে একটা করি- তাতে করে আমাদের প্রতি ক্রমাগত মানুষের সমর্থন বাড়ছে, মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে, আমাদের আয়োজনের প্রতি মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এটি আমাদের শক্তি। এটিই আমাদের মোকাবেলা।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, মানুষের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড তখনই প্রয়োজন পড়ে, যখন মূল রাষ্ট্রের শক্তি মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ায়। আমাদের শক্তি তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আমাদের চেতনার পক্ষে, রাষ্ট্রের পক্ষে। সুতরাং সেখানে রাষ্ট্রের দিকেই আমরা প্রথমত চেয়ে থাকব, যে সবকিছুকে মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্র কী করছে। কারণ আমাদের কর্মকাণ্ড যেন এমন একটা অরাজকতার সৃষ্টি না করে, যা প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রশাসনকে ব্যর্থতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে। যে এ রকম একটা ঘটনা ঘটছে অথচ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সুতরাং সেক্ষেত্রে আমরা ছেড়ে দিব প্রশাসনিকভাবে যেন সেসব নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু আমাদের যে কাজটা ছিল এই কাজে আমরাও অবশ্যই খানিকটা উদাসীন ছিলাম যে উদাসীনতার সুযোগ তারা নিয়েছে। সেটা হচ্ছে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির কর্মকাণ্ডে আমাদের মনোযোগ ছিল না। আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের সব মনোযোগ শহরের দিকে চলে এসেছিল। সেই মনোযোগ অনেকটাই তাদের আর্থিক নানা রকম সুযোগ-সুবিধার দিকে চলে গেছিল। এই সুযোগটাই মৌলবাদীরা নিয়ে সেখানে নানা রকম ধর্মের নামে, ধর্মসভার নামে ওয়াজের নামে তাদের মনগড়া নানা রকম সা¤প্রদায়িক কথাবার্তা, অমানবিক কথাবার্তা মানুষের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, মানুষের কানে পৌঁছে দিচ্ছে।

সরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আমলাদের মধ্যে মৌলবাদী প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারি দল দুটো এক জিনিস নয়। সরকারি যে রাজনৈতিক দল, তারা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। আর সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দল বা দলের ম্যান্ডেট নিয়ে থাকে না। তারা যখন যে সরকার আসবে, সে সরকারের হয়ে কাজ করবে। কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে দীর্ঘদিন। ফলে তাদের মধ্যে যারা বেশ কট্টর এবং যারা বেশ মৌলবাদী চেতনায় উজ্জীবিত, তারা মাঝে মাঝে এই সরকার এতদিন কাজ করে যাচ্ছে, এজন্য তাদের মধ্যে একটা গাত্রদাহ, সে কারণে তাদের নানা কর্মকাণ্ডে তা প্রকাশ পেয়ে যায়।

মৌলবাদীদের ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষার কৌশল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মৌলবাদের ভয়াবহতা কোনো অংশে কম ছিল না ব্যাপক ছিল, ৪৭-এর দাঙ্গা কি কম ভয়াবহ ছিল। কিন্তু তারপরে কদিন লাগল ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেখান থেকে ফেরত এলো। এ রকম হুজুগে ব্যাপার থাকে। এসব অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারণে হয়েছে। সাধারণ মানুষকে অশিক্ষা ও কুশিক্ষা দিয়ে আমরা মোকাবেলা করতে পারি না। মসজিদগুলো ছেড়ে দিয়েছি মৌলবাদীদের হাতে। আগে যারা ইমাম ছিলেন এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন, তাদের কথাবার্তা আমি পুরনো বইপত্র ঘেটে পড়েছি অনেক প্রগতিশীল ছিলেন তারা, আধুনিক ছিলেন। এ বিষয়ে আমাদের কঠোরভাবে নজর দেয়া সময় এসেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App