×

জাতীয়

মুন্সীগঞ্জের রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয় ঘিরে সক্রিয় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২, ০৮:২২ এএম

মুন্সীগঞ্জের রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয় ঘিরে সক্রিয় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি!

হৃদয় কৃষ্ণ মণ্ডলে

মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুরের শতবর্ষ পার হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বছর ত্রিশেক আগে ‘আরকে’ উচ্চ বিদ্যালয় করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচড়া দিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়, স্কুলে ১৩ জন হিন্দু শিক্ষকের চাকরি করাই দায় হয়ে পড়ে। কিছু হলেই ধর্মের বিষয় টেনে এনে অমুসলিমদের কটাক্ষ করা হতো। নিত্যনৈমিত্তিক এমন পরিস্থিতির মধ্যে মাস দুয়েক আগে শিক্ষার্থীদের বেতন স্কুলের অফিসে জমা দেয়া নিয়ে করণিক জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ওই স্কুলে কর্মরত শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঝগড়া হয়। পরে পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য মাহবুব হোসেন, ম. মনিরুজ্জামান শরীফসহ সিনিয়র শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে হৃদয় ও জাহাঙ্গীর একে অন্যকে ‘সরি’ বলেন। কিন্তু ঘটনার রেশ এখানেই থেমে থাকেনি। বরং সেখান থেকেই শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে ফাঁসানোর নতুন পরিকল্পনার জন্ম হয়। যার সর্বশেষ মঞ্চায়ন হচ্ছে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে শিক্ষক হৃদয়ের বিরুদ্ধে দুটি মামলা ও ১৯ দিনের কারাবাস। গতকাল বিনোদপুর ঘুরে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধলেশ্বরীর তীরে অবস্থিত এই বিদ্যালয়ে এতকিছু ঘটেছে, নানাজন সম্পৃক্ত থেকে নিরীহ বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে জেলে দিয়েছে। তীব্র আন্দোলনের মুখে সেই শিক্ষক জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এখন সবাই দায় খালাস করে বলছেন, শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক। মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা তারা ধলেশ্বরীর স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। পুলিশের তদন্তেও গাছাড়া ভাব। সবমিলিয়ে যেন কিছুই ঘটেনি বিনোদপুরে, রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে!

জানতে চাইলে স্কুলের উত্তরপাশের গলিতে অবস্থিত একটি দোকানের মালিক মো. মনির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, হৃদয় স্যার অত্যন্ত ভালো মানুষ। ধর্ম অবমাননার যে ভিডিও ছাত্ররা বের করেছে সেটি আমি শুনেছি। সেখানে তিনি কোথায় ধর্ম অবমাননা করলেন সেই লাইনটিই খুঁজে পাইনি। অথচ কোনো একটি সূত্র থেকে ধর্মের অবমাননার কথা বলে ছাত্রদের উসকে দিয়ে স্যারকে হেনস্তা করা হলো।

স্কুল থেকে একটু দূরে রিকাবীবাজারের সাতরং আর্ট প্রিন্টিংয়ের মালিক তাহের মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, স্কুলের একটি চক্র কোনোভাবেই হৃদয় স্যারকে বাগে আনতে পারছিল না। পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্য, কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারী ছাত্রদের দিয়ে ধর্ম অবমাননার অডিও রেকর্ড প্রচার করে শান্ত ধলেশ্বরীর তীরকে অশান্ত করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু হৃদয় মণ্ডলকেই নয় এর আগে ইংরেজির শিক্ষক মিজানুর রহমান পারভেজকেও ওই চক্রটি নানাভাবে হেনস্তা করেছে। অথচ শিক্ষক মিজানুর রহমান মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি স্কুলের এসব বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছে কম্পিউটার বিষয়ের যে নোট দেয়া হতো সেটি তৈরি করে দিতেন স্কুলের কম্পিউটার অপারেটর নয়ন ইসলাম। সেই কাগজগুলোতে কুরআন, হাদিসের বাণী লেখা থাকত। এর ফলে বাধ্য হয়ে অমুসলিম শিক্ষার্থীদেরও তা পড়তে হতো। এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছিলেন শিক্ষক হৃদয়। এর আগে শিক্ষার্থীদের স্কুলের বেতন জমা নিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়ান করণিক জাহাঙ্গীর। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শিক্ষক রিয়াসাত উল্যাহ বাদল, আক্কাছ আলী খান, তাজরীন শিকদার নাঈম। সবমিলিয়ে হৃদয় স্যারের পেছনে এরাই ষড়যন্ত্র শুরু করে। তবে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন শিক্ষক বলেন, গত ২০ মার্চ ছাত্ররা হৃদয় স্যারের কথা ভিডিও করে এবং প্রধান শিক্ষক এই খবর পেয়ে যান। ওই দিনই পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য ও স্কুলের উল্টোদিকে থাকা চালের আড়তের মালিক মাহবুব হোসেনকে ডেকে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ সমাধানের কথা বলেন। কিন্তু মাহবুব সেদিন প্রধান শিক্ষকের ডাকে স্কুলে যাননি। বরং পরদিন ২১ মার্চ ছাত্ররা মাহবুব হোসেনের কাছে এলে তিনি প্রমাণ আছে কিনা জানতে চান। মূলত মাহবুব হোসেন নীরব থাকার কারণেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।

মাহবুব হোসেনের নীরব থাকার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, স্কুলের একটু দূরে অবস্থিত মাইজভান্ডারির অনুসারী গাউছুল আজম নামে একটি মসজিদ রয়েছে। সেখানেই মাহবুব হোসেনের শ্বশুর থাকেন। তিনি এলাকায় মাইজভান্ডারির ‘পীর’ বলে পরিচিত। এই মসজিদ থেকেই ২৩ মার্চ হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মিছিল বের করার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশ সেই মিছিলকে রাস্তায় নামতে দেয়নি। আবার স্কুলে নানা সময় বিভিন্ন মত নিয়ে হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে মাহবুব হোসেনের সম্পর্কও ভালো ছিল না।

জানতে চাইলে মাহবুব হোসেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, হৃদয় আমাকে বন্ধু বলে ডাকাত এবং সে অত্যন্ত ভালো মানুষ ও জনপ্রিয় শিক্ষক। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আগে ভালো মানুষ ছিলেন, এখন কি তিনি খারাপ মানুষ- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব বলেন, সে পরিস্থিতির শিকার। ছাত্ররা আন্দোলনে যাওয়ার আগে আপনার কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নিয়েছিল- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা এসেছিল। সবশুনে আমি বলেছি, তোমরা হেড স্যারের সঙ্গে কথা বল। তিনিই সমাধান করবেন। হেড স্যার তো সমাধানের জন্য আপনাকে তার অফিসে ডেকেছিলেন, আপনি গেলেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো স্কুল কমিটির সাবেক মেম্বার। এছাড়া চালের ব্যবসা করি। চৈত্র মাস চলছে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ঘটনার তিন দিন পর আপনার শ্বশুরের মসজিদ থেকে মিছিলের জন্য মাইকিং করা হয়েছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আপনারা ওই পরিচয়ও নিয়েছেন নাকি বলে আর কথা না বাড়িয়ে চালের দোকান বন্ধ করে ধলেশ্বরীর তীর ঘেঁষে হাঁটা শুরু করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেছেন, স্কুলের সামনেই ব্যবসায়ী কামালের তুষের দোকান রয়েছে। ২২ মার্চ ছাত্ররা যেদিন আন্দোলন করে সেদিন কামালের ছেলে তুহিন ৩৫/৪০ জনের বহিরাগত একদল ছেলে নিয়ে স্কুলের ভেতরে হাজির হয়ে সাম্প্রদায়িক নানা শ্লোগান দিতে থাকে। এ সময় স্কুলের রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক তাজরীন শিকদার নাঈম তুহিনকে বলেন, এত কম সংখ্যক ছেলে দিয়ে কিছু হবে না। আশপাশের সব স্কুল ও মাদ্রাসায় খবর দিতে হবে যাতে আরো বেশি সংখ্যক ছেলে এসে পুরো এলাকাকে অচল করে দেয়। তাজরীন শিকদার নাঈমের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেছেন, সেদিন বহিরাগতরা ছিল।

জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ ভোরের কাগজকে বলেন, স্কুলের আশপাশে কয়েকজন শিক্ষক বাসায় ছাত্র পড়ান। ওখানেই তারা শিক্ষার্থীদের উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পাঠ শেখান। ওরাই শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে হেনস্তা করেছে। পরিচালনা কমিটির সদস্যরা চাইলে এটা স্কুলের ভেতরেই নিরসন করতে পারত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এসব বিষয়ই নয়, স্কুলের টাকা-পয়সা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। এনিয়ে দুদকেও অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই শিফটে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। আগে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করলেও এখন পরিচালনা কমিটির কারণে স্কুলটি করুণ অবস্থা পৌঁছেছে। তাদের নানারকম দুর্নীতির কারণে স্কুলটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্থানীয় সরকার দলীয় সাংসদের ‘ডিও’ লেটারের মাধ্যমে মনোনীত হওয়া সভাপতি ও তার পার্ষদরা স্কুলের কয়েক কোটি টাকা মেরে খেয়েছেন। স্কুলের মালিকানায় ১০টি চালের আড়তের অগ্রিম ভাড়া বাবদ নগর ৮০ লাখ টাকা নেয়া হলেও স্কুলের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। গত বছরের পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া প্রায় ৫০ লাখ টাকার কোনো জমা খরচের হিসাব নেই। স্কুল শিক্ষকদের পিএফ ফান্ডের ১৫ লাখ টাকা সভাপতি তুলে নিয়ে কী করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। স্কুল কমিটির সদস্য ও প্রধান শিক্ষক মিলেমিশে এই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। অডিটকারী দল এলেও তাদের ঘুষ দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়। এসবের বিষয়ে শিক্ষকরা কথা বললেই কমিটির লোকজন তাদের অপমান, হেনস্তা করেন।

স্কুল পরিচালনা পরিষদের এডহক কমিটির সভাপতি মো. মহিউদ্দিন খান আলমগীর যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে সাবেক কমিটির সদস্য ম. মনিরুজ্জামান শরীফ ভোরের কাগজকে বলেন, এসব দুর্নীতির কথা জানা নেই। এমনকি তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের জীবনে এমন ঘটনা ঘটতেই দিতেন বলে জানিয়েছেন। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে ভালো মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা এই অপমান করেছে তাদের আমিও খুঁজছি। তবে তিনি হৃদয় মণ্ডল হেনস্তায় জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেছেন, মুন্সীগঞ্জের রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের গত কমিটিতে স্থানীয় সাংসদ এডভোকেট মৃণাল কান্তি দাসের লোকজন ছিলেন। কিন্তু ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এডহক কমিটি গঠন হয়। এই এডহক কমিটিতে যারা আছেন তারা মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিনের অনুসারী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনার পর স্থানীয় সাংসদ এডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস যেমন চুপচাপ থেকেছেন তেমনি মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিনও নীরব। জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে কি ঘটেছে তা তিনি জানেন না বলে মন্তব্য করে বলেন, ওই স্কুলের কোনো ঘটনাই আমি জানি না। অন্যদিকে স্থানীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস চুপ থাকার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, মুরাদনগর, নাসিরনগরে যখন ঘটনা ঘটেছে আমি সবার আগে গিয়েছি। কিন্তু আমার নির্বাচনী এলাকায় এমন স্পর্শকাতর ঘটনার পর সঙ্গত কারণেই চুপ থেকেছি। তবে চুপ থাকার মধ্যেও আমি আমার মতো করে ক্রিয়াশীল ছিলাম। ক্রিয়াশীল থাকার সব বিষয় প্রকাশ না করলেও চলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংকট সমাধান করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। রোজার দিনে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাড়িয়ে লাভ কী?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App