×

মুক্তচিন্তা

হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় ও নন্দকুঁজা নদী

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২২, ১২:৩০ এএম

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের ২০১৯ সালের একটি রায়ে দেশের নদীগুলোকে জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের সংগঠনের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তুরাগ নদীকে লিভিং এনটিটি ঘোষণা করা হলেও পরে দেশের সব নদীর ক্ষেত্রে এই রায় বহাল রাখা হয়। এই যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, যা জীবন্তসত্তা হিসেবে একজন মানুষ সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে থাকেন। আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের নদ-নদীগুলো এখন থেকে প্রাণী যেমন কিছু আইনগত অধিকার ভোগ করে; তেমনি অধিকার নদীও ভোগ করবে। নদীর প্রতিনিধি হয়ে কেউ আদালতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জানালে নদী প্রতিকার পাবে। বিশ্বব্যাপী নদীর আইনগত সত্তা ধারণার সূচনা হয়েছে কলম্বিয়ার আদালতের একটি রায় থেকে। নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ নদীকে লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজ্য আদালত থেকে নর্মদা নদীকে লিভিং এনটিটি ঘোষণা করা হয়েছে। নন্দকুঁজা একটি নদীর নাম। নন্দকুঁজাকে ঘিরেই এক সময় গড়ে উঠেছিল আহমেদপুর, হালসা, হোলাইগারি, নাজিরপুর, গুরুদাসপুর, চাঁচকৈড়ের মতো বড় বড় হাট-বাজার। বাজারগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালোই চলত। সে সময় নন্দকুঁজা নদীতে বছরজুড়েই পানি থাকত। বছরের পর বছর পলি পড়ে আর ড্রেজিং না করার কারণে নদী এখন খালে পরিণত হওয়ার পথে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদী হারিয়েছে তার সৌন্দর্য আর জৌলুস। এখন বর্ষাকালে নদী পানিতে ভরে থাকলেও বর্ষা শেষ হলে পানির দেখা মেলে না; পানি শুকিয়ে যায়। নদীতে অনেক আগেই নৌ চলাচল বন্ধ হয়েছে। নদী দখল আর বর্জ্য ফেলে ভরাট করার কারণে নদী সংকুচিত হয়েছে। নদীকেন্দ্রিক কর্মজীবী মানুষ হয়েছে বেকার, তারা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। প্রভাবিত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি জমিতে সেচ কাজ ব্যাহত হয়েছে। প্রতিবেশ ব্যবস্থা, জলজ প্রাণী আর মৎস্যসম্পদ পড়েছে হুমকির মুখে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানি দিনের পর দিন নিম্নগামী হচ্ছে। গভীর নলকূপের উত্তোলিত পানি এখন এই অঞ্চলের কৃষকের চাষবাসের ভরসা। নন্দকুঁজা নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলা সদর ঘেঁষে এবং বড়াইগ্রাম, সিংড়া ও নাটোর সদর উপজেলার বেশ কিছু অংশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কীর্তিনাশা-পদ্মা থেকেই যার উদ্ভব; কিয়দাংশ যা বড়াল নামেও প্রবাহিত হয়েছে। নারদ নদ নন্দকুঁজায় বিসর্জিত হয়েছে। নন্দকুঁজা আবার বিসর্জিত হয়েছে গুমানী নদীতে আর গুমানী পড়েছে বড়ালে, বড়ালের যাত্রার সমাপ্তি ঘটেছে হুরা সাগর নদীতে। যমুনায় পতিত হয়ে হুরাসাগরের আত্মতৃপ্তি ঘটেছে। মাঝে আত্রাই আর নন্দকুঁজা মিলে পরিণত হয় গুমানী নদীতে। ভাবা যায় একসময় নন্দকুঁজা নদীতে লঞ্চ চলত! নিয়মিত চলত গহনার নৌকাও। বহুকালের সাক্ষী নন্দকুঁজা আজ প্রৌঢ়। নাটোর চিনিকলের বর্জ্যে নন্দকুঁজা দূষিত হয়। বর্জ্যরে প্রভাবে নদীর পানি বিষিয়ে ওঠে, এতে নদীর পানি নষ্ট হয়ে যায়। পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি পচা পানিতে শুধু মাছই নয়, মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। নদী তীরবর্তী জনপদের মানুষ সেচ, স্নানসহ ঘর-বাড়ির কাজে এখন নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছে না। দূষিত পানি ভুল করে কেউ ব্যবহার করলে আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত রোগে। অবহেলিত নদীটি আজ মৃত প্রায়। প্রকাশ্যেই তিলে তিলে নন্দকুঁজা নদীর মৃত্যু ঘটছে। দুই বছর পূর্বে নন্দকুঁজা খনন শুরু কাজ শুরু হলেও অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। নদী আমাদের সভ্যতার বিকাশে অনেক অবদান রেখেছে। নদীকে নদীর মতো বাঁচতে দেয়া উচিত। নন্দকুঁজা নদী ড্রেজিং করার দাবি রাখে। নন্দকুঁজা নদীকে রক্ষার জন্য সুশীল সমাজসহ স্থানীয় পৌরসভা, স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর, নদী রক্ষা কমিশন একক অথবা যৌথ ভূমিকা রাখলে নন্দকুঁজা ফিরে পেতে পারে তার হারানো রূপ। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় রক্ষার অভিভাবক। নদীগুলোকে জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করার পর নদ-নদী রক্ষায় আদালতেরও ভূমিকা বেড়েছে। হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় ঘোষণার বিষয়টি নন্দকুঁজা পাড়ের সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে ও সচেতন করতে হবে। এখন নদী রক্ষায় আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। নন্দকুঁজা নদীর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে দূষণ-দখল প্রতিরোধ করাসহ চিনিকলের বর্জ্য যেন নদীর পানিতে না মিশতে পারে, এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই নন্দকুঁজা পাড়ের মানুষের জীবন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে এবং নন্দকুঁজা নদী ফিরে পাবে প্রাণশক্তি।

ফাত্তাহ তানভীর রানা : গল্পকার ও কবি। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App