ইউক্রেন নিয়ে কী খেলা চলছে?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২২, ১২:৩২ এএম
পশ্চিমা শক্তিগুলো কী চায়- ইউক্রেনে শান্তি, না বিলম্বিত যুদ্ধ এবং সেই সুবাদে তাদের অস্ত্র বাণিজ্য? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দ্বিতীয়টিই তাদের কাম্য। তাই কি পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণে পশ্চিমা শক্তির বাধা না দেয়া বা নীরব থাকার কারণ। জো বাইডেনকে ভুল বুঝেছিলেন অনেকে। বিদেশ নীতিতে তিনিও বোধহয় ভিন্ন গোত্রের নন। তা না হলে গত সপ্তাহখানেক সময় ধরে যখন ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে আলোচনা চলছে, কিছুটা হলেও শান্তির সুবাতাসের সম্ভাবনা দিচ্ছে সংবাদপত্রের ‘হেড লাইন’গুলোতে; তখন নতুন করে সেখানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানো কেন? বরং চলুক না শান্তির জন্য বহুমুখী আলোচনা, যুক্তরাষ্ট্র নিক না এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা? কিন্তু না, এর বিপরীত ধারাটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। একটি দৈনিকের (প্রথম আলো, ১৮.৩.২০২২) লিড শিরোনাম : ‘ইউক্রেন পাচ্ছে আরো অস্ত্র ও গোলাবারুদ’। এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভালোই মুনাফা হবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের এবং পরোক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ গত দুদিনের খবরে শান্তি আলোচনার প্রাধান্য। জেলেনস্কি বললেন, তিনি আশাবাদী। ন্যাটোতে যোগদানে অনিচ্ছা প্রকাশ্যে জানালেন তিনি। এই ন্যাটো নিয়ে যত ফ্যাঁকড়া। কী দরকার ছিল তার ন্যাটোর সদস্য হওয়ার? বিচক্ষণ রাষ্ট্রনীতিবিদ হলে তিনি বুঝতে পারতেন নাকের ডগায় ন্যাটোর নিয়মতান্ত্রিক উপস্থিতি পুতিন সহ্য করবেন না। সে চিন্তা তার ছিল না। তাই বলতে হয় রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বিচারে প্রথম ভুলটা ইউক্রেনের। কিন্তু পুতিনও কেন প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে এ সম্পর্কে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় না বসে প্রথমেই অশান্তির পথ বেছে নিলেন?
দুই. ইউক্রেনের রুশ নাগরিক-প্রধান দুটি শহরে তাদের নিরাপত্তার অজুহাতে কেন হঠাৎ ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলেন। অথচ আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য রাজধানী কিয়েভ। এ স্ববিরোধী আচরণের কী জবাব দেবেন পুতিন? আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েও তো আলোচনা চলতে পারত ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে। পুতিন ভুলে গেলেন কেন, বিজয়ী হলেও যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি উভয়পক্ষের, কম আর বেশি। আলোচনায় সুফল মিলতেও পারত, ইউক্রেনের সুবুদ্ধির উদয় হতে পারত। যুদ্ধে এই যে ইউক্রেনের মানবসম্পদ, বস্তুগত সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, এর পূরণ কি তার পশ্চিমা মিত্ররা করবে, কখনোই না। নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিই তো সর্বোত্তম পন্থা। হঠাৎ মাথা বিগড়ে গেল কেন ইউক্রেনের শক্তিমান ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বাসনায়। কার পরামর্শে? ইতোমধ্যে এ যুদ্ধে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ইউক্রেনের। সামরিক-বেসামরিক উভয় দিকে। ইউক্রেন কি দিবাস্বপ্ন দেখেছিল যে, যুদ্ধে পশ্চিমা শক্তি তাদের সহায়তায় মাঠে নামবে? অনেক ভেবেও আমি কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছি না, কী ভেবে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার মতো একটি সাধারণ ঘটনার সূত্রে ইউক্রেন পুতিনের আক্রমণের শিকার হতে গেল? এটাকে দূরদর্শী রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি বলে না। ইউক্রেন কি ভাবছে পশ্চিমা অস্ত্রের শক্তিতে সে পুতিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হবে? বিশ্বে এ পর্যন্ত অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যুদ্ধে ব্যাপক মানবসম্পদ, বস্তুসম্পদ নষ্ট হয়েছে। আর যুদ্ধ নয়, অনেক যুদ্ধবিরোধী গান, শান্তির গান রচিত হয়েছে। এমনকি শান্তির কপোতও উড়ানো হয়েছে আকাশে। কিন্তু যুদ্ধবাজদের মহিমায় আঞ্চলিক যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা বিশ্বযুদ্ধ চায় না, সেটা যেখানেই হোক। মানুষ শান্তি চায়, নিরাপদ জীবনযাপন চায়। চীন ইউক্রেন প্রসঙ্গে যুদ্ধের সমর্থক নয়, কিন্তু রুশ-চীন শান্তিচুক্তির কারণে পুতিনের নীরব সমর্থক। তবু সে শান্তির পক্ষে, যুদ্ধের দ্রুত অবসানের পক্ষে আলোচনার মাধ্যমে। আলোচনায় উভয়পক্ষই আন্তরিক বলে মনে হয় না। আলোচনা চলছে, রুশ হামলাও চলছে, এটা কী অদ্ভুত ঘটনা। বেসামরিক খাতে হামলা রীতিমতো আপত্তিকর। এ সত্যটা কি পুতিন জানেন না? কিয়েভ দখলের অর্থ হবে ইউক্রেন দখল। তখন কি পশ্চিমা শক্তি চেষ্টা করবে ইউক্রেন বিভক্ত করতে, হয় সরাসরি, না হয় জাতিসংঘের মাধ্যমে, যা এ যাবৎ একাধিকবার ঘটতে দেখা গেছে। পুতিন কি চাইবেন ইউক্রেনের বিভক্তি? পুতিন চান বা না চান, ইউক্রেন তা চাইবে না। কে তার ভূখণ্ড বিভক্তি চায়? উপমহাদেশের ঘটনা ব্যতিক্রম। কোরিয়া চায়নি, জার্মানি চায়নি। পুতিন কি ভুলে গেছেন একদা ইউক্রেন কথা সোভিয়েত আমলে। যদি পূর্ব ইতিহাস মনে থাকে পুতিন এবং ইউক্রেন-প্রধানের, তাহলে অখণ্ড স্বাধীন ইউক্রেনের স্বার্থে দুজনেরই উচিত অবিলম্বে অর্থবহ শান্তির টেবিলে বসে যুদ্ধ স্থগিত করে যুক্তিসঙ্গত যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো এবং এর মধ্যে বিরূপ শক্তিকে নাক গলাতে দেয়া ঠিক হবে না। আন্তরিকতার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অনেক কিছু সমাধান সম্ভব। সে সুযোগ হারানো ঠিক হবে না। এক কথায় ইউক্রেন যুদ্ধ বিলম্বিত করা উচিত হবে না। বিলম্বিত যুদ্ধ অনেক অঘটন ঘটায়। এ সত্য রাষ্ট্রনায়কদের জানা না থাকার কথা নয়। ইউক্রেনকে নতুন রকম অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ বিলম্বিত করার কৌশল যে যুক্তরাষ্ট্রের পুতিনের তা বুঝতে পারার কথা। তার উচিত ইউক্রেনকে ওই ফাঁদে পুরোপুরি পড়ার আগেই ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো। আর জেলেনস্কিরও বোঝা উচিত, যত অস্ত্রই আসুক না কেন, যুদ্ধে তার ক্ষতি বৈ লাভ নেই। তার ভুল নীতি ইউক্রেনবাসীর দুর্ভোগ বাড়াবে বৈ কমাবে না। ইউক্রেন যুদ্ধ উপলক্ষে যে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার কথা সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদনে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তাতে ইউক্রেনের সমূহ ক্ষতি। এর প্রভাব কি নিকট প্রতিবেশী রাশিয়াকে স্পর্শ করবে না? আর সে যুদ্ধ কিছুটা ব্যাপক হলেও পৃথিবীর অপর পিঠে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রকে স্পর্শ করবে না। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে যুদ্ধের সবচেয়ে সুফলভোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ওই সর্বনাশা পথে কেউ পা বাড়াবে না। তবু ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতায় না গেলে নাকের ডগায় ন্যাটোর সম্ভাবনা বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিলম্বিত যুদ্ধের পরিণামে এ আশঙ্কাগুলো পুতিনের রাশিয়ার জন্য নেতিবাচক ফলাফল তৈরি করতে পারে। ইউক্রেনের কপালে যা ঘটার তা তো ঘটবে। বিবিসির বিশ্লেষণে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে এবং যা আরো অনেকেরই প্রশ্ন তা হলো, এ অভিযানের পেছনে পুতিনের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায়টি কী? শুধুই ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়া, না কি আরো গভীর কিছু। এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো বিশেষ আলোকপাত করেননি, পুতিন এ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে মুখ খোলেননি। এটাই এখন ইউক্রেন যুদ্ধের বড় বাধা। পুতিন কি ইউক্রেন দখল করতে চান? সেটা সম্ভব নয়। কারণ পশ্চিমারা তা হতে দেবে না। তাহলে কি চান ইউক্রেনের ওপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক? সেটাও কি পশ্চিমা শক্তি সুনজরে দেখবে? মোটেই না। যদিও ইউক্রেন একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেই ছিল। স্বাধীন ইউক্রেন হঠাৎ রুশ সীমান্তে ন্যাটোকে আনার পরিকল্পনায় সঠিক কাজ করেছে বলে মনে হয় না। এ পদক্ষেপ পুতিনকে উসকে দেয়ার যে যথেষ্ট সে সুবুদ্ধি জেলেনস্কির থাকা উচিত ছিল। অন্যদিকে পুতিনের পক্ষে আলোচনার প্রাথমিক প্রচেষ্টা না করে যুদ্ধে নামা বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়। কারণ শান্তিপূর্ণ পথে সমাধানের চেষ্টা সর্বদা অগ্রগণ্য বিবেচিত হয়, পুতিন সে চেষ্টা করেননি। ক্ষোভ একটা কারণ হতে পারে। তবু শান্তিপূর্ণ পথ অগ্রগণ্য। আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।