×

জাতীয়

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তারে অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২২, ০৩:২৪ পিএম

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তারে অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। ফাইল ছবি

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তারে অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

মুন্সিগঞ্জের একটি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের একটি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে আটকের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বুধবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে দ্রুত ও বিনা শর্তে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া উচিৎ। খবর বিবিসির।

হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে। স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষার একটি ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে ধর্ম আর বিজ্ঞানের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেটা গোপনে ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার পর সেই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ২২ মার্চ হৃদয় চন্দ্রকে গ্রেপ্তারের পর গত সপ্তাহে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত দুই দফায় তার জামিন আবেদন নাকচ করেছে। এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে রবিবার। সেদিন পুনরায় তার পক্ষে জামিনের আবেদন করা হবে বলে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন।

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ঘটনার পর বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো সংঘর্ষ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই, কখনও ছিল না, আগামীতেও থাকবে না। সুতরাং সংঘর্ষের কোনো পরিস্থিতি কিংবা কারণ দেখছি না।

শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, তবে একটা বিষয় থাকতে পারে, একে পুঁজি করে, বিষয়টিকে সামনে এনে এবং সাংঘর্ষিক একটি পরিস্থিতি তৈরি করে একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে চাইছে একটা সাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ধর্মে ধর্মে এক ধরনের সংঘাত তৈরির জন্য। যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করতে চায়, কট্টর সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের পক্ষ থেকে এটি অপচেষ্টা। সে বিষয়ে আমরা ভালোভাবেই জানি।

তিনি আরও বলেন, একজন শিক্ষক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং তথ্যের ভিত্তিতে একটা বিষয়কে ব্যাখ্যা করবেন। সেখানে তাকে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে, যার সঙ্গে বিজ্ঞান শিক্ষা বা ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি আলোচনা সৃষ্টি করে বিতর্ক করার জন্য এবং পরিস্থিতির শিকার করার জন্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

পাকিস্তানে এ ধরনের নানা ঘটনায় সহিংসতা, অপদস্থ করার কথা উল্লেখ করে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল আলম চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে যাতে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আমি মনে করি আমাদের পুলিশ ও বিচার প্রশাসনকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। কে কি বলল, কে কি শুনল, তার ওপর ভিত্তি করে মামলা গ্রহণ করা, আবার তার ওপর ভিত্তি করে জামিন না দেয়া, এগুলো সঠিক বলে আমার কাছে মনে হয় না।

তিনি বলেন, এটি যদি একটি উদাহরণ হিসেবে সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমাদের সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে।

‘পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে’ অভিযোগ

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক। সেই স্কুলের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও ছাত্রদের কথাবার্তা গোপনে ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাই তারা এ ঘটনাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলে মনে করছেন।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, দশম শ্রেণির ক্লাসে ছাত্র ও শিক্ষকের প্রশ্নোত্তরের ঘটনা ঘটে ২০ মার্চ। কিন্তু তার পরদিন ১০-১২ জন ছাত্র এসে তার কাছে বিজ্ঞান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ করে।

প্রধান শিক্ষক বলেন, ছাত্রদের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি সেই শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বরখাস্তও করেন। এরপরও ২২ মার্চ সেই শিক্ষকের বাড়িতে হামলা করা হয়।

২২ মার্চ সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয় এবং সেদিনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে তাকে আর জামিন দেয়া হয়নি।

প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যে ঘটনার যে ধারাবাহিকতা এসেছে, তা পর্যালোচনা করেও অনেকে ঘটনাটিকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলে মনে করছেন। মুন্সিগঞ্জের আইনজীবী সমিতিও অভিযোগ করেছে, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে পরিকল্পনামাফিক পুরো ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। এ সমিতির সভাপতি অজয় চক্রবর্তী বলেন, প্রকৃতপক্ষে পরিকল্পিতভাবে তাকে (শিক্ষক হৃদয় চক্রবর্তী) হয়রানি করার জন্য এ কাজ করা হয়েছে।

তিনি মনে করেন, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া শিক্ষকের বক্তব্য গোপনে ভিডিও করা ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ধর্ম এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে ছাত্ররা শিক্ষকের কাছে যে ধরনের প্রশ্ন করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আইনজীবী অজয় চক্রবর্তীর। তিনি বলেন, প্রশ্নগুলোও আগের প্রস্তুতি নিয়ে করা হয়েছে। তারা দেখতে চেয়েছে যে প্রশ্নের জবাব ঐ শিক্ষক কীভাবে দেয়। সেখানে বিভিন্নভাবে জবাব নিয়ে সেটা দিয়েই উসকে দিল।

এ ঘটনার বিষয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। তবে অনেকে আবার মনে করেন, ধর্ম এবং বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্রদের প্রশ্নের জবাবে সেই শিক্ষকও এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যা নিয়ে অভিযোগ করা বা প্রশ্ন তোলার সুযোগ হয়েছে।

পুলিশ যা বলছে

মুন্সিগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন বলেছেন, সব অভিযোগ বা সব প্রশ্নেরই জবাব খুঁজবে তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। সে মামলার তদন্তে সব বিষয়ই দেখা হবে।

ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, বিভিন্ন অভিযোগ বা প্রশ্নের বিষয়ে তদন্ত করা হবে।

এদিকে, গ্রেপ্তার থাকা সেই শিক্ষকের স্ত্রী ববিতা হালদার বলেন, আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভয়ের মধ্যে আছি। আমরা বাসার ছাদে উঠলেই আশপাশে থেকে অনেকে কটূক্তি করে। আমার ছেলেকেও স্কুলে পাঠাচ্ছি না।

তবে শিক্ষকের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে পুলিশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App