×

মুক্তচিন্তা

একটি জমজমাট পহেলা বৈশাখের অপেক্ষায়!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২২, ০১:১২ এএম

এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, এ বছর স্বাভাবিক নিয়মেই এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানাদি পালন করা হবে। সারাদেশে নতুন উদ্যমে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। মেট্রোরেলের কারণে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তা সুবিধাজনক অবস্থায় না থাকার দরুন টিএসসি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে। এদিকে ছায়ানটও তাদের নিয়মিত মহড়া শুরু করেছে এবং রমনা বটমূলে ছায়ানটের সংগীত পরিবেশনা সব প্রস্তুতি চলছে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নতুন বছরের সূর্যোদয় হয়, এটা এখন বাংলা নববর্ষের সব আনুষ্ঠানিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাই এবার মনে হচ্ছে পহেলা বৈশাখ যেন আবার নতুন রূপে হাজির হচ্ছে। এবং অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার যে, বাংলা নববর্ষ সমস্ত জরাজীর্ণ এবং অন্ধকারকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে মহাধুমধামে আবার আমাদের সামনে নতুন রূপে হাজির হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রবল প্রতাপে গোটা বিশ্ব যেভাবে নিজেদের অনেক স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থগিত বা সীমিত করে মহামারির মোকাবিলা করেছে, বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০০০ সালের মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরা পরার পর থেকে সব ধরনের কার্যক্রম বিশেষ করে সব ধরনের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা ও পাবলিক গ্যাদারিং প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০০ সালের মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন- এ চার মাস গোটা বাংলাদেশ ছিল কঠোর বিধিনিষেধের আওতায়, যাকে লকডাউন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ২০২১ সালেও করোনা ভাইরাস নতুন নতুন ধরন নিয়ে হাজির হয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সারাদেশে পহেলা বৈশাখের সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করা হয়েছিল। ফলে রমনা বটমূলে ছায়ানটের গান কিংবা চারুকলা ইনস্টিটিউিটের নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা করা সম্ভব হয়নি বলে, বাংলা নববর্ষ উদযাপন ছিল রীতিমতো উৎসবহীন এবং ম্রিয়মাণ। নানাভাবে অনলাইনে ভার্চুয়ালি আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে খানিকটা আয়োজন করা হয়েছিল কিন্তু পহেলা বৈশাখের সে প্রাণ আর প্রাচুর্য সেখানে ছিল না। ছিল না মাটিবর্তী সংস্কৃতির কোনো আমেজ। তাই এ বছর মহাধুমধামে পহেলা বৈশাখ পালনের প্রস্তুতি বাংলা নববর্ষকে নতুন সাজে সাজিয়ে সবাইকে চিরায়ত বাংলার রূপ, রস ও গন্ধে মাতাবে, এটা ভাবতেই দারুণ এক পুলক বোধ করছি। যেন করোনা মহামারির সব জীর্ণতা, দীনতা, হীনতা, শাপ, পাপ মুক্ত এক নতুন বাংলাদেশে আমরা প্রবেশ করব বাংলা নববর্ষের জৌলুসপূর্ণ জমজমাট আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে। এদেশের আকাশে, বাতাসে, নদী, বৃক্ষ, জলাশয়, ধানক্ষেতে, ফুলের বাগানে, পশুপাখির কলকাকলীতে মুখরিত হবে বাংলা নববর্ষের নতুন সুরে এবং নতুন জীবনের নতুন উদ্দীপনায়। ভাবতেই পুলক বোধ করছি। করোনা ভাইরাসের দমবন্ধ সময় কাটিয়ে নতুন জীবনের নতুন জয়গান নিয়ে পহেলা বৈশাখ আসুক নতুন বার্তা নিয়ে, এ আনন্দ অপার। পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি স্মারক হয়ে উঠেছে এর নিজস্ব রূপ বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের নানান জীবনবাদি কোলাহলে প্রায় যখন হারাতে বসেছে, তখন পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা আমাদের নতুন করে বাঙালিত্বের স্বাদ প্রদান করে। ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের কালে, ভার্চুয়াল জগতের মোহনীয় বিস্তারের যুগে এবং আকাশ সংস্কৃতির বেয়াড়া বিকাশের সময়ে নিজস্ব মাটিবর্তী সংস্কৃতি যখন মানুষ হাইব্রিড সংস্কৃতির ডামাডোলে প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসে, তখন প্রতি বছর মহাধুমধামে পহেলা বৈশাখ উদযাপন, আমাদের নতুন করে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে তাকানোর মওকা তৈরি করে দেয়। ফলে প্রতি বছর জমজমাট আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন, কেবলই শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের মৌসুমি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এর মধ্য দিয়ে নিজের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে নতুন করে এক ধরনের সম্পর্ক ও সংযোগ স্থাপনের একটা সুযোগ তৈরি করে নিঃসন্দেহে। তাছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি, এর নানান বৈচিত্র্যময় অনুষঙ্গ, এর নানান রূপ এবং নানান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দেয় পহেলা বৈশাখের নানান আয়োজন। তাই আমরা পহেলা বৈশাখের নানান আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে প্রকারান্তরে নিজের শেকড়ের সঙ্গে এক ধরনের সংযোগ স্থাপন করি। সংযোগ স্থাপন করি পূর্ব প্রজন্ম এবং উত্তর-প্রজন্মের মধ্যে যার মূল মেলবন্ধন হচ্ছে বাংলার হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, গৌরবোজ্জ্বর ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে যেখানে বাংলাদেশের প্রধান লেখককের নানান ভাবনা-চিন্তা প্রকাশিত হয়। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বাঙালি সংস্কৃতির নানান উপাদানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ পায়। এখানে মনে রাখা জরুরি, আমরা একটা বহুজাতিক সংস্কৃতির আগ্রাসনের মধ্যে বাস করি। আর এ আগ্রাসন আমাদের মধ্যে আমদানি করে মিডিয়া এবং অনলাইন জগৎ। তাই পহেলা বৈখাখের আনুষ্ঠানিকতা অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির একটা তুলনামূলক চেহারা দেখার সুযোগ করে দেয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সংস্কৃতি তাই বাংলার চিরায়ত এবং লোকায়ত সংস্কৃতির একটা আবহ তৈরি করে সর্বত্র। পাশাপাশি, পান্তা-ইলিশ, নানান পিঠা-পুলি এবং নানান ভাজি-ভর্তার যে বাঙালি চিরায়ত খাদ্য-সংস্কৃতি সেটাও পহেলা বৈশাখের নানান আনুষ্ঠানিকতার সুবাদে আমাদের আস্বাদন করার সুযোগ তৈরি করে। এছাড়া লাল-সাদা শাড়ি, পাঞ্জাবি কিংবা নানান বাহারি রঙের পোশাক পরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি, সেটাও সবার মধ্যে বাংলা নববর্ষ পালনের এক ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি করে। শিশু, কিশোর, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বাংলা নববর্ষ পালনের যে উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতা, এটা এক ধরনের দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশমাতৃকার প্রতি মমত্ববোধকে বিস্তারিত করে। দেশজ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ তৈরি করে। পরিশেষে বলব, বিগত দুটি বছর করোনা ভাইরাসের কারণে একটা অস্থির, আশঙ্কা ও আতঙ্কের যে সময় আমরা পার করেছি, আগামী পহেলা বৈশাখ যেন আমাদের সব রোগবালাই, সব জীর্ণতা, সব শঙ্কা-আতঙ্ক এবং সব নেতিবাচকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নবপ্রাণে, নবোদ্যমে, নতুন আলোয় এবং নতুন উচ্ছ¡াসে নতুন জীবনের সূচনা করে, সে প্রত্যাশা নিরন্তর। একটি জমজমাট পহেলা বৈশাখের প্রত্যাশায়!! ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App