×

রাজধানী

মশা মারতে বছরব্যাপী চলবে সমন্বিত কার্যক্রম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৮:৪৬ এএম

মশা মারতে বছরব্যাপী চলবে সমন্বিত কার্যক্রম

প্রতীকী ছবি

বিগত বছরগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে চায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তাই মশা মারতে এবার আগেভাগে প্রস্তুতি ও কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থা দুটি। ইতোমধ্যে পুরো বছরের মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। ডেঙ্গুর প্রাক মৌসুম, মূল মৌসুম এবং মৌসুম পরবর্তী করণীয় রাখা হয়েছে এই কর্মপরিকল্পনায়।

মশা মারতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। মশক নিধনে দুই সিটির এই পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখার পরও নগরবাসীকে মশার ধকল সইতে হবে কেন- ইতোমধ্যেই এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের কাজ লোক দেখানো। ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্সকালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেন রয়েছে। যেগুলোয় দুই সিটি মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। প্রধান সড়কের পাশে ওষুধ স্প্রে করেন মশক নিধনকর্মীরা। ভেতরের গলিতে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। এছাড়া অভিজাত এলাকাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, অন্য এলাকাকে সেভাবে দেয়া হয় না।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছর এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। বৃষ্টি শুরু হলে এই ঘনত্ব আরো বাড়বে। এতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগগুলো আরো মারাত্মক আকারে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা গবেষকদের। এই মুহূর্তে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনের জোরালো অভিযান দরকার বলেও মনে করে অধিদপ্তর।

জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের কাগজকে বলেন, রাজধানীতে এখন যেসব মশা দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে ৯৮ ভাগই কিউলেক্স। পানি শুকিয়ে ঘন হচ্ছে। এমন পরিবেশ কিউলেক্স মশার বংশবিস্তারের জন্য সহায়ক। অতি সম্প্রতি ঢাকার জলাশয়গুলোয় সার্ভে করে দেখা যায়, মশার ঘনত্ব প্রায় ৬০ ভাগ। তিনি বলেন, প্রজাতি ভেদে মশাগুলোকে আগে আলাদা করে নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা করতে হবে। এক্ষেত্রে সিটি কপোরেশনের উচিত এখনই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে তাদের পরামর্শগুলো কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা।

দুই সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মশা মারতে শুধু ওষুধ ছিটানোকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্য পদ্ধতিগুলো সমন্বয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জরিপ ও নিরীক্ষণ জোরদার, গবেষণাগার ও র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠনের পাশাপাশি বিশেষ পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে কীটতত্ত্ববিদদের সহায়তায় জরিপ চালানো হবে। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিদর্শন, তদারকির জন্য ‘মশক নিধন সেল’ গঠন করা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) : এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির বছরব্যাপী কার্যক্রমকে তিনটি সময়ে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো : প্রাক-মৌসুম কার্যক্রম (জানুয়ারি-মার্চ), মৌসুমের কার্যক্রম (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) এবং মৌসুম পরবর্তী কার্যক্রম (অক্টোবর-ডিসেম্বর)। প্রাক-মৌসুম কার্যক্রমের মধ্যে আছে মশার উৎপত্তিস্থল হিসেবে নালা, খাল, জলাশয়, মজা পুকুর থেকে কচুরিপানাসহ অন্যান্য ময়লা পরিষ্কার করা। মাঠপর্যায়ে কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে অবহিত করা। কীটনাশক, মশার জন্মস্থান ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশগ্র্রহণ নিশ্চিত করা। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এডভোকেসি সভার আয়োজন করা। কপোরেশনের নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি ওয়ার্ড পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা ১০ জন মশক নিধনকর্মীর মধ্যে পাঁচজন ফগার ও স্প্রে মেশিনের সাহায্যে মশার লার্ভা ও উড়ন্ত মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। বাকি পাঁচজন এডিস ও কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

ডেঙ্গুর মৌসুমে বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো, পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন বাড়ি, মেট্রোরেল প্রকল্প, চিড়িয়াখানা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, থানার পরিত্যক্ত গাড়ি প্রভৃতি স্থান ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী, মসজিদের ইমাম, বাড়ির মালিক সমিতির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমপক্ষে একটি এডভোকেসি সভার আয়োজন করার পরিকল্পনা আছে। এছাড়া শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ইমামদের মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত বার্তা প্রচার করা হবে।

প্রতি সপ্তাহে জরিপের মাধ্যমে রোগীর তথ্য পর্যালোচনা এবং তদারকির জন্য সেল গঠন করা হয়েছে। ৩ মাস পর পর কীটতত্ত্ববিদদের দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হবে। এরপরও মশা মারাত্মক আকার ধারণ করলে র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম গঠন করে উপযুক্ত উপকরণ দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া গেলে তার বাড়ির আশপাশে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার ব্যবস্থা থাকবে।

মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই কাউন্সিলরদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার সমন্বয় সভা করার নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এডিস মশার প্রাদুর্ভাব ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমরা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। তবে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সহযোগিতা করতে হবে। তিনি বলেন, সুস্থতার জন্য সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সবাই মিলে ‘১০টায় ১০ মিনিট প্রতি শনিবার, নিজ নিজ বাসাবাড়ি করি পরিষ্কার’ স্লোগানটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে চলমান সামাজিক আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে হবে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী মো. সেলিম রেজা বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে ডিএনসিসির রিসোর্স বাড়ানো হয়েছে। মশা নির্মূলে গবেষণা করে সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র (হটস্পট) চিহ্নিত করে সেগুলো ধ্বংস করতে বাড়ি বাড়ি চিরুনি অভিযান অব্যাহত থাকবে। ডেঙ্গুর কারণে যাতে আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, জনগণ এখন জানে কেন ডেঙ্গু হয় এবং কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয়। এরপরও যদি কেউ সচেতন না হন তাহলে আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা করা হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) : ইতোমধ্যে মশক নিয়ন্ত্রণের কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে সাজানো হয়েছে পরিকল্পনা। মশক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত লড়াইয়ের অংশ হিসেবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত মানসম্মত কীটনাশকের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

পাশাপাশি চলতি মাসে স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে আঞ্চলিক পরামর্শ ও অবহিতকরণ সভার আয়োজন করবে ডিএসসিসি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করা হবে। মাসের শেষের দিকে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে জরিপ চালানো শুরু করবে ডিএসসিসি। মশক নিধনকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এই মাসে কীটনাশক ও যন্ত্র সংগ্রহ, প্রচারপত্র ও স্টিকার বিতরণের কাজ শুরু করবে ডিএসসিসি।

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ডভিত্তিক শোভাযাত্রা, মে মাসে অঞ্চলভিত্তিক এবং এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয়ভাবে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা করার পরিকল্পনা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে সপ্তাহের সাতদিন ওয়ার্ডভিত্তিক মাইকিং করা হবে। আর প্রচারপত্র বিতরণ ও গণপরিবহনে স্টিকার লাগানোর কার্যক্রম চলবে বছরব্যাপী।

জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাধ্যমে নিবিড় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড এই তিন পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা করা হবে। এর মধ্যে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতি সপ্তাহে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভা করা হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতি মাসে ন্যূনতম ৩টি প্রতিষ্ঠানে সভা এবং মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সভা করার পরিকল্পনা করেছে ডিএসসিসি।

চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ১৫টি বাড়ি, মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৫০টি বাড়ি এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ওয়ার্ডে প্রতিদিন ১৫টি বাড়িতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম চলবে। বছরজুড়ে চলবে কীটনাশক দেয়ার রুটিন কার্যক্রম। আর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে এই কার্যক্রম জোরদার করা হবে। এপ্রিল, জুন ও আগস্টে সপ্তাহব্যাপী কীটনাশক প্রয়োগের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করা হবে।

মশক নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা নিয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, গত বছরের ১৬ মে কোভিড-১৯ ও ডেঙ্গু মহামারির মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি এবং এর জন্য সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনায় রদবদল এনেছি। তিনি বলেন, রদবদলকৃত কর্মপরিকল্পনা অনুসারে ডিএসসিসি তার আওতাধীন ৭৫টি ওয়ার্ডে সারা বছর দৈনিক ভিত্তিতে সুসমন্বিত কার্যক্রম শুরু করেছে। মেয়র বলেন, কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ডিএসসিসিকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল, আধুনিক মেশিনারিজ এবং পর্যাপ্ত ভালো মানের কীটনাশক সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App