×

জাতীয়

ভারসাম্যের কূটনীতির বড় পরীক্ষা আজ ওয়াশিংটনে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২২, ০৮:০৬ এএম

ভারসাম্যের কূটনীতির বড় পরীক্ষা আজ ওয়াশিংটনে!

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারসাম্যের কূটনীতির বিষয়টি আরেক দফা সামনে আসার পর ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আলোচনা চলছে। এরপরই সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এই ভারসাম্যের কূটনীতি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক ফল নিয়ে আসবে? তবে এটা ঠিক এই ভারসাম্যের কূটনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পছন্দ করছে না। তবু কেন বাংলাদেশ সেই কূটনীতির পথে রয়েছে সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই আজ সোমবার ঢাকা-ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। এতে দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ই উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনীতির বড় পরীক্ষার ক্ষেত্র বলেও মনে করছেন অনেকে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকটি দেশের গুরুত্ব বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভারসাম্যমূলক কূটনীতি অবশ্যই ইতিবাচক হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ চীন, জাপান, ভারত, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে বোঝাপড়া করতে পেরেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পার করবে ওয়াশিংটন ও ঢাকা। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পালন করতেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের আমন্ত্রণে গতকাল শনিবার রাতে ওয়াশিংটন গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ওয়াশিংটনে আজ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এই বৈঠকে সম্পর্কের সামনের দিনগুলোতে একসঙ্গে চলা, র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা ইস্যু, ইন্দো-প্যাসিফিক, খুনি রাশেদকে ফেরতসহ নতুন নতুন ক্ষেত্রে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেবে ঢাকা। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বীকৃতির এই দিনে ঢাকা চেষ্টা করছে ওয়াশিংটনের আরো ঘনিষ্ঠ হতে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বৈঠকে একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও বাংলাদেশিদের আগ্রহ থাকবে র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেন, সে বিষয়ে। পাশাপাশি এই নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে প্রভাব পড়েছে তা কাটিয়ে মসৃণভাবে পথচলা এবং নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে মার্কিন কর্মকর্তাদের বোঝানোই বড় কাজ বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, র‌্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত মার্কিন সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে অনৈতিক। এনিয়ে প্রতিবাদ করেছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রীও সংসদে কথা বলেছেন। আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট দূর করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্লিংকেনের সঙ্গে বৈঠকেই র‌্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা না উঠলেও এটি নিয়ে অগ্রগতি হতে পারে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে যত কঠিন বিষয়ই হোক না কেন তা সহজেই সমাধান করা যায়। মার্কিন সরকার সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাবে কিনা- সেটাই বড় প্রশ্ন।

এর আগে গত ২০ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অষ্টম অংশীদারিত্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপ শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড সাংবাদিকদের জানান, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে আরো কাজ করতে হবে। তবে নিষেধাজ্ঞার পর তিন মাস র‌্যাবের কর্মকাণ্ডে তার দেশ সন্তুষ্ট বলেও জানান আন্ডার সেক্রেটারি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের দুর্বলতা রয়েছে কিনা, গত ৩০ মার্চ সাংসদে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নাইন/ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে সন্ত্রাস দমনে তখনকার বিএনপি সরকার র‌্যাব সৃষ্টি করেছিল। তবে তারা র‌্যাবকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পর জঙ্গি, সন্ত্রাস দমন, হত্যার তদন্তসহ মানবিক কাজই করছে র‌্যাব; মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়। তারা মানবাধিকার রক্ষায়ই কাজ করছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছে, এদের কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে যখন একটি অস্বাভাবিক সরকার থাকে অথবা অবৈধ দখলদার কেউ যদি থাকে, তখন তারা খুব ভালো থাকে, তাদের খুব গুরুত্ব থাকে। যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান থাকে, তারা ভালো থাকে না। এ জন্য তারা সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে লেগেই থাকে। যতই ভালো কাজ করুক, তারা পেছনে লেগেই থাকে। কারণ, তারা ভালো দেখতে চায় না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ওয়াশিংটন বৈঠকে আমরা র‌্যাবের বিষয়টি তুলব। আর তারা বলবে, নিশ্চয়ই একটা প্রসেস আছে। আমরা তাদের বলতে চাই, এ প্রতিষ্ঠানটা হওয়ায় আমাদের দেশে সন্ত্রাস কমেছে। শুধু আমাদের দেশে সন্ত্রাস নয়, আমাদের আশপাশের দেশের সন্ত্রাসটা অনেক কমে গেছে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য। সুতরাং তোমাদের ওদের (র‌্যাব) সম্মান করা উচিত। তোমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমরা বুঝলাম তোমাদের একটা প্রসেস আছে। আমরা আশা করব, তারা ইতিবাচক সাড়া দেবে। পাশাপাশি আলোচনায় থাকবে আগামী ৫০ বছরে কীভাবে আমরা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি, বিনিয়োগ বাড়ানো, রোহিঙ্গা, জলবায়ুর মতো বিষয়গুলো। জলবায়ু পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনার প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ক্লাইমেট আমাদের জন্য বড় ইস্যু। এক্ষেত্রে আমাদের কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আমরা আলোচনা করব। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরতের প্রসঙ্গ বৈঠকে তোলা হবে কিনা জানতে চাইলে মোমেন বলেন, আমরা এটা তুলব।

নিরাপত্তা সংলাপ : আগামী ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সংলাপ বসবে। এরই মধ্যে ওয়াশিংটন মিলিটারি ইস্যুতে বাংলাদেশকে জিসমিয়া ও আকসা নিয়ে দুটি চুক্তির খসড়া কপি দিয়েছে। বাংলাদেশ চুক্তি দুটি করবে কিনা কিংবা এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কি জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে আমরা ঝাঁপ দিয়ে পড়ব না। যারা এগুলো দেখার তারা এগুলো আগে পরীক্ষা করে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করব না। আমরা তো অস্ত্রের ভাণ্ডার সৃষ্টি করতে চাই না। কারণ আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা খুব শান্তি প্রিয় দেশ। সব প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক। অস্ত্র সংগ্রহ করলেই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব আসে। আমরা ওগুলোতে নেই। তোমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) অন্যান্য প্রযুক্তি আছে, সেটা আমাদের দাও। অস্ত্র আমাদের খুব কম প্রয়োজন। কারো চাপে পড়ে বাংলাদেশ কিছু করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাপের মুখে আমরা কিছু করব না। আমরা আমাদের দেশের মঙ্গলের জন্য যা যা প্রয়োজন সেগুলো করব।

ইন্দো-প্যাসিফিক প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অনুরোধ করেনি। এটা একটা দর্শন। এ দর্শনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মোটামুটি এক। তারা যেটা বোঝাতে চায়, অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অঞ্চল। আমরাও সেটা চাই। কোনো রাষ্ট্র এটাকে বাধাগ্রস্ত করুক তারা এটা চায় না, আমরাও চাই না। এক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি এক। তিনি বলেন, কিন্তু তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ভয়টা হলো, চায়না তো এখানে মাতব্বরি করছে। এ কারণে তারা একটা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু আমরা কারো লেজুড় হতে চাই না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App