×

জাতীয়

সড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২২, ০৮:২৬ এএম

সড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

কাভার্ড ভ্যান চাপায় নিহত সহপাঠী মাইশা মমতাজ মিমের ঘাতকদের বিচারসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে শনিবার রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা -ভোরের কাগজ

সড়কে আবারও মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই ঝড়ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। গত তিন বছরে এ দুর্ঘটনা ও এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যায় যে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একক আন্দোলনের মুখে নতুন সড়ক আইন করা হলেও এখনো সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর হারই বেশি। রাজধানীতে এর সর্বশেষ বলি হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাইশা মমতাজ মিম। গত শুক্রবার সকালে উত্তরার বাসা থেকে স্কুটি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে কুড়িল ফ্লাইওভারে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় মীম নিহত হন। ওই ঘটনার পর মীমের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার দাবিতে তার সহপাঠীরা আবারো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন সড়ক আইনের কঠোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় পরিবহনের চালকরা আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নতুন আইন পাস হওয়ার পরে এর কঠোর প্রয়োগের কারণে কিছুদিন দুর্ঘটনা কমেছিল। কিন্তু এখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আগের মতোই সড়কে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একের পর এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।

২০১৮ সালে এশিয়া এন্ড প্যাসিফিক কাউন্সিলের প্রকাশিত ‘সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স ফর ঢাকা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে মাত্র ৩৮ শতাংশ মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’ তবে বাস্তবে গত তিন বছরে রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে মানুষের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ আরো বড়েছে। এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার আপ্রাণ চেষ্টার পরেও দুর্ঘটনা ও মৃত্যু প্রতিরোধে সফলতা এখনো দৃশ্যমান হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দুর্ঘটনার পর সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ার কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব সড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অন্যরাও সচেতন হবে। আর এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার কমবে। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেন এই অধ্যাপক। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।

কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা সাধারণত একক কোনো কারণে ঘটে না। সব সড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং করতে হবে। তাহলেই একটি দুর্ঘটনা ঘটলে কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু আমাদের সব সড়কে এখনো প্রযুক্তির ব্যবহার হয় না। তাছাড়া একটি দুর্ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত নিয়ে বড় ধরনের গাফিলতি লক্ষ্য করা যায়। দুর্ঘটনার মামলা হয়, কিন্তু বেশির ভাগ মামলারই তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। যথাযথ তদন্তে দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। দোষীরা শাস্তি পেলেই সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে। আধুনিক গবেষণা ও তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কিছু কিছু দুর্ঘটনা একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। ঢাকা শহরে দুর্ঘটনায় বড় যানবাহনগুলোর সম্পৃক্ততা বেশি। এসব যানবাহনের চালক গতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অতটা সচেতন থাকে না। যারা নিয়োগ দিচ্ছে, গাড়িটি হাতে তুলে দিচ্ছে, তারাও নিয়োগ দেয়ার সময় চালকের লাইসেন্স বা দক্ষতার ব্যাপারে খোঁজ নেয় না। চালকদের প্রশিক্ষণ নেই। এ ধরনের অদক্ষ চালক রাস্তায় নামলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব না। এছাড়া পথচারী ও যাত্রীদের চলাচলেও সমস্যা রয়েছে। তারা ইচ্ছেমতো রাস্তা পার হয়। গাড়ির ইন্ডিকেটর লাইট না দিয়েই অনেক চালক লাইন-লেন ক্রস করে, তখন দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে আমরা অনেক সুপারিশ করেছি। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি একেবারেই সন্তোষজনক না হওয়ায় অব্যবস্থাপনা রয়েই গেছে, দুর্ঘটনা ঘটছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ৮০৩ জনই শিক্ষার্থী ছিল। অর্থাৎ ওই বছর নিহতদের ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুকে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা ‘হত্যা’ বলেই অভিহিত করছেন। আর এসব মৃত্যুর জন্য পরিবহনের চালকরাই দায়ী। ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, গত বছর ৬২ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল যানবাহনের বেপরোয়া গতি। চালকদের অদক্ষতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। সড়ক পরিবহনে ‘টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন না করা’ এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়াও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন। সরকার এই দুটি বিষয়ে ব্যবস্থা নিলেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমবে। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। আর সচেতনতার বিষয়টি নির্ভর করে জনগণের ওপর।

অতীতে দেখা গেছে, দেশের পরিবহন খাত কখনোই শৃঙ্খলার মধ্যে ছিলো না। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজনই সব সময় এই খাত নিয়ন্ত্রণ করেছে। বেপরোয়া চাঁদাবাজির ভাগ পেয়েছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা। এখনো সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে যখনই কোনো টেকসই ও জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয় তখনই সুবিধাভোগীরা ‘কমিটি গঠন’ এবং ‘সুপারিশমালা’ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করেছে। এখনো সব উদ্যোগই ‘কমিটি গঠন’ ও ‘সুপারিশের’ মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাস্তায় কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা যাদের দায়িত্ব তারাও বার বার উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ যথাযথ বাস্তবায়ন, বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়ানো, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, দক্ষ চালক গড়ে তোলা, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণসহ ১১১টি সুপারিশ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। এসব সুপারিশ স্বল্প-মধ্যম-দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের পরিকল্পনার কথা বলা হলেও দুর্বল প্রয়োগ সবাইকেই ভাবিয়ে তুলছে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ার পেছনে সড়ক আইনের কঠোর প্রয়োগে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাই দায়ী। আর এ কারণেই চালকরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নে কে কতটা আন্তরিক সেটা আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখেছি। অথচ তা বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন আমাদের এত মৃত্যু দেখতে হতো না। দুর্ঘটনার কারণগুলো সবার জানা, কিন্তু আইন বা সুপারিশ কোনোটিরও পুরোপুরি বাস্তবায়ন নেই।

বিআরটিএর হিসাবে প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন নিহত হয়। এই হিসাবে বছরে ১০ হাজার ৮০০ জন নিহত হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ : লিডারশিপ প্রায়োরিটিস এন্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যায় ১০২ জন। ওয়ার্ল্ড হেলথ র‌্যাংকিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম স্থানে রয়েছে। জিম্বাবুয়ে ৬১ দশমিক ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। নিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষে সুইডেন। এই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হার ২ দশমিক ৩১ শতাংশ।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সড়কে কোনো দুর্ঘটনা আমাদের কাম্য নয়। তা প্রতিরোধে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সচেতনতা ও সহযোগিতা আগের চেয়ে বেড়েছে। দুর্ঘটনা কমাতে আমাদের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তারপরেও দুর্ঘটনা ঘটছে, এটা খুবই দুঃখজনক। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারাও এটা চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় আমরা ব্যথিত। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে একটি টাস্কফোর্স কাজ করছে। ১১১টি সুপারিশ বিভিন্ন মেয়াদে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App