×

জাতীয়

ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক, সন্তুষ্ট নয় ভোক্তা অধিদপ্তর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৯:০৪ এএম

ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক, সন্তুষ্ট নয় ভোক্তা অধিদপ্তর

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

  • পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ
  • ফের বৈঠক বুধবার

দেশে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং দিন দিন বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে বাজারে তৈরি হয় ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে স্থানীয় বাজারে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ভোজ্যতেল লিটারে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে বাজার অভিযানের পাশাপাশি ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর তেল সরবরাহ ও পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কারখানা পরিদর্শন শুরু করে। পরিদর্শনে বেশ কিছু তথ্য ‘গরমিল’ ও ‘অনিয়ম’ পাওয়ার কথা জানানো হয় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বাজারে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী ৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪টিকে তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এস আলম, এডিবল অয়েল, বসুন্ধরা ও টিকে- এ ৪টি গ্রুপের তেল সরবরাহ ও তথ্য দেয়ায় অনিয়ম পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় রাজধানীর টিসিবি ভবনে। তাদের জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে আগামী বুধবার আবারো শুনানিতে ডেকেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

গতকাল বুধবার এ চার কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তেল আমদানি, পরিশোধন ও সরবরাহকারী এসব কোম্পানি ছাড়াও দামে ‘কারসাজির’ সঙ্গে অন্যান্য পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতা যাচাইয়ে মৌলভীবাজার ও খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীদের তালিকাও চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সম্প্রতি আমরা বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কোম্পানিগুলোর কারখানা পরিদর্শন করি। তাতে বেশ কিছু অনিয়ম ও অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। এ পরিদর্শনে দেখা গেছে, কোম্পানিগুলো ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চ মাসে বাজারে কম তেল সরবরাহ করছে। এছাড়াও আমরা বেশ কিছু অনিয়ম দেখেছি। আমরা কিছু গোপন তথ্যও পেয়েছি। তাই শুদ্ধতার জন্য এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে ডেকেছিলাম।

তিনি বলেন, শুনানিতে যেসব তথ্য দিয়েছে তা আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এজন্যই আমরা তাদের অধিকতর শুনানির জন্য ডেকেছি। গত রোজার তিন মাস আগে প্রত্যেকটা মিল কতটা প্রোডাকশনে ছিল, এবারের রোজার তিন মাস আগে কতটুকু ছিল, এসব তথ্য আগামী বুধবারের বৈঠকে দিতে বলা হয়েছে। আমরা চাই তারা এসবের স্বচ্ছ তথ্য আমাদের দেবে।

তিনি আরো বলেন, ভোজ্যতেলের মূল্য কারসাজি শুধু মিল মালিকরাই নয়, মৌলভীবাজার ও খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরাও করতে পারে। তাই এই দুই বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের তালিকাও চাওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি, মৌলভীবাজারে হঠাৎ করে একটা মূল্য নিয়ে কারসাজি করা হয়, আবার তারা মিলের দোহাই দিয়ে বলেন, মিল থেকে দিচ্ছে না। তাই এবার আমরা দুপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করব।

তিনি জানান, ডিলারদের যে সাপ্লাই অর্ডার (এসও) দেয়া হয় সেটা তিন মাসের বেশি হলে তা বাতিল করতে হবে। রমজানে দাম বাড়ানোর চেষ্টা যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের থাকে সে সুযোগ এবার আমরা দেব না, যোগ করেন তিনি।

জানা গেছে, এর আগে গত সোমবার ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে ভোজ্যতেল নিয়ে মিল পর্যায়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ৩টি সরবরাহ ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে ৩টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ এডিবল অয়েল মিলে ভোক্তা অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ টিম নিয়োগ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন তারা।

অধিদপ্তর থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, গত ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেকে এস আলমের কারখানা পরিদর্শন করা হয়। ওই সময় তাদের কারখানায় ড্রামের গায়ে পণ্যের নাম, মেয়াদ ও মূল্য উল্লেখ ছিল না। তেল রিফাইনারি ও বোতলজাতকরণ শাখা বন্ধ ছিল। ৫ লিটারের মোড়কে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৮৩৫ টাকা লেখা ছিল, যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এরপর ২৭ মার্চ আবারো পরিদর্শন করা হয়। দ্বিতীয়বার দেখা যায়, সরবরাহ আদেশ বা এসওতে একক মূল্যের উল্লেখ নেই। নিয়মবহির্ভূতভাবে এসওগুলো কারখানায় আসার আগে হাতবদল হচ্ছে। এসব অনিয়মের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যই বুধবার এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে বলা হয়।

নারায়ণগঞ্জে টিকে গ্রুপের কারখানায় পাওয়া অনিয়ম সম্পর্কে চিঠিতে বলা হয়, কোম্পানিটি ফেব্রুয়ারি মাসে ২৭ হাজার ৩৭১ টন পাম তেল বিপণন করলেও মার্চে এসে তা কমে ২১ হাজার ১১৯ টনে নেমে আসে। হঠাৎ সরবরাহ কমে যাওয়ার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ৩০ মার্চ টিকে গ্রুপের চেয়ারম্যান অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ডেকে পাঠানো হয়েছে। এদিকে রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ হাজার ৩৮ টন তেল সরবরাহ করা হলেও মার্চ মাসে তা ৮ হাজার ২৬৩ টনে নেমে আসে। তাদের কাছেও সরবরাহ কমানোর ব্যাখ্যা দিতে তাদের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ৩০ মার্চ হাজির হতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে মিলারদের নিয়ে অভিযোগ করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, ভোজ্যতেল আমদানির ৯০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে বড় পাঁচ প্রতিষ্ঠান। আর দাম বাড়াতে ঘি ঢালছে কিছু অসাধু ডিলার।

এদিকে, ভোজ্যতেলের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে পাকা রশিদ ছাড়া পাইকারি পর্যায়ে আর ভোজ্যতেল বেঁচাকেনা করা যাবে না। অর্থাৎ খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যখন পাইকারদের কাছ থেকে তেল কিনবেন তখন সেটির প্রকৃত মূল্য পাকা রশিদে লিখে নিতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ে নিয়োজিত ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্ট কিংবা সরকারি অন্যান্য সংস্থা এই রশিদ যাচাই করতে চাইলে তা পাইকার কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীদের তৎক্ষণাৎ দেখাতে হবে। এমনকি ভোক্তারা যদি প্রকৃত মূল্য যাচাইবাছাই করতে চায় তাহলে তা দেখাতে বাধ্য থাকবেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মিলগেট থেকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতে যৌথ মনিটরিং টিম গঠনের দাবি করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার থেকে সরকার নির্ধারিত প্রতিলিটার ১৬০ মূল্যের বোতলজাত তেল বাজারে আসছে জানিয়ে তিনি এর চেয়ে কেউ বেশি মূল্য চাইলে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইন ১৬১২১ নম্বরে জানানোর জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ করেন।

গতকাল শুনানি শেষে বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস মোহাম্মদ দবিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। আমরা মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টন ভোজ্যতেল সরবরাহ করি। এটা বাজারের চাহিদার খুব ছোট অংশ। একইভাবে বৈঠক থেকে বের হওয়ার পথে টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আতহার তাসলিম বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী মিলগেটে তেল পাওয়া যাচ্ছে না বলে যে অভিযোগ করা হয়েছিল তা ঠিক করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App